পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়িতে রাবার বাগান রয়েছে প্রায় পাঁচ শ। বাগানমালিকদের দাবি, চলতি মৌসুমে রাবারের উৎপাদন বাড়লেও কাঙ্ক্ষিত দাম পাওয়া যাচ্ছে না, লোকসানে পড়তে হচ্ছে তাঁদের।
বাগানমালিকেরা জানিয়েছেন, গত অক্টোবর মাসেও প্রতি কেজি রাবারের সরকার–নির্ধারিত মূল্য ছিল ২৮৮ টাকা। অথচ নাইক্ষ্যংছড়িতে রাবার বিক্রি হয়েছে ১৪০-১৪৫ টাকা দামে। প্রতি কেজি রাবারের (রস) বিপরীতে ১৪০ টাকা খরচ হয়। এ পরিস্থিতিতে রাবার আমদানিতে ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপ এবং রাবারকে কৃষিপণ্য ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন বাগানমালিকেরা।
কক্সবাজার শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে নাইক্ষ্যংছড়ির ‘বাইশারী রাবার শিল্প এলাকা’। কক্সবাজার সদর উপজেলার ঈদগাঁও হয়ে রামুর ঈদগড় সড়ক ঘুরে যেতে হয় বাইশারীতে। গত ২৫ নভেম্বর সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সেখানকার অন্তত ১০ হাজার একরের পাহাড়-টিলায় রাবার উৎপাদনের ধুম পড়েছে।
বাইশারীর সাপেরগাড়া এলাকায় ৪৫০ একরের নিরিবিলি রাবার বাগান। বেলা ১১টায় বাগানে ঢুকে দেখা যায়, ৪০-৫০ জন শ্রমিক (টেপার) গাছে বাঁধা প্লাস্টিকের বাটি (পাত্র) থেকে সাদা রস (স্থানীয় ভাষায় কষ) সংগ্রহ করছেন। অধিকাংশ শ্রমিক চাকমা ও মারমা সম্প্রদায়ের। ৩০ জন শ্রমিকের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে রয়েছেন সাইম্যু মারমা (৩৫)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভোর চারটার দিকে শ্রমিকেরা বাগানে ঢুকে রাবার গাছের বাকল কেটে দেন। পরে দুপুরের দিকে পুনরায় গিয়ে রস সংগ্রহ করা হয়। বেলা একটার মধ্যে রস সংগ্রহের কাজ শেষ করে টেপাররা বাড়িতে ফিরে যান। টেপারদের মাসিক বেতন ১২ হাজার টাকা। মাসে দুই দিন ছুটি। বাগানের শ্রমিক আনুষে মারমা (৩০) ও মংসি প্রু (৩৫) বলেন, দুর্গম বাইশারীর রাবার বাগানে কাজ করা ছাড়া তাঁদের আয়ের কোনো বিকল্প পথ নেই। রাবারের দাম কমে যাওয়ায় তাঁরা শঙ্কায় রয়েছেন।
রাবার বাগানটির ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আলম (৫০) বলেন, গত সেপ্টেম্বর মাসেও তাঁরা প্রতি কেজি রাবার বিক্রি করেছেন ২৯০ টাকায়। অক্টোবর মাস থেকে বিক্রি হয়েছে ১৪০-১৪৫ টাকায়। গত দুই মাস লোকসান দিয়েই রাবার বিক্রি চলছে। তাতে ৯০ জন শ্রমিকের বেতনসহ আনুষঙ্গিক খরচ ওঠানো সম্ভব হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, তাঁদের বাগানে ১২ বছর আগে এক লাখ চারাগাছ লাগানো হয়েছিল, বর্তমানে ৭২ হাজার গাছ থেকে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার কেজি রাবার উৎপাদিত হচ্ছে। ২৫ নভেম্বর উৎপাদিত হয়েছে ৩ হাজার ১৫৯ কেজি। গত বছর পুরো বাগান থেকে রাবার উৎপাদিত হয়েছিল ৭১ হাজার কেজি।
রাবার বাগানের মালিক লুৎফর রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে রাবারের দাম বাড়ছে। তবে নাইক্ষ্যংছড়িতে ৫-৬ জনের একটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট মূল্য কমিয়ে রেখেছে। তিনি বলেন, রাবার আমদানিতে শুল্কহার ৫ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে বিগত সরকার। শুল্কহার বাড়ানো না হলে বাইশারীর সম্ভাবনাময় রাবারশিল্প পথে বসবে।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান তোফাইল আহমেদ বলেন, উপজেলার ৪৫ হাজার ২৩০ একর বনভূমির ১৬ হাজার ৫০০ একরে প্রায় ৫০০টি রাবার বাগান রয়েছে। এসব রাবার বাগানের মালিকানায় রয়েছেন ৪৩১ জন। আরও ৬ হাজার একরের টিলাভূমিতে রাবার বাগান হচ্ছে। নাইক্ষ্যংছড়ির রাবার বাগানে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে রাবারের মূল্য অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় বাগানমালিকদের দিশেহারা অবস্থা।
ঈদগড় ও বাইশারি এলাকার কয়েকজন বাগানমালিক জানান, অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত চার মাস রাবার উৎপাদনের ভরমৌসুম। এ সময় প্রতিটি গাছ থেকে ৯০ গ্রাম পর্যন্ত রস উৎপাদিত হয়। ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আট মাসে রাবার উৎপাদন কমে অর্ধেকে নেমে এসেছিল। তখন প্রতিটি গাছে রস পাওয়া যায় ৩৫-৪০ গ্রাম।
নাইক্ষ্যংছড়িতে বাগানমালিকদের কাছ থেকে রাবার কিনে ব্যবসা করেন ফেনীর বাসিন্দা মো. আলাউদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২৬ বছর ধরে তিনি নাইক্ষ্যংছড়িতে রাবারের ব্যবসা করে আসছেন। বাইশারিতে তাঁর নিজেরও ১৭৫ একর বাগান রয়েছে। তাতে শ্রমিক রয়েছেন ৭০ জন। সিন্ডিকেট করে রাবারের দাম কমিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন তিনি।
মো. আলাউদ্দিন বলেন, চলতি মৌসুমে রাবারের বাম্পার উৎপাদন হচ্ছে। আগে রাবারের বড় ক্রেতাদের একটি ছিল ঢাকার গাজী গ্রুপ। প্রতিবছর তাঁদের কারখানায় ৯০০ মেট্রিক টন রাবার কেনা হতো। এখন প্রতিষ্ঠানটি রাবার কেনা বন্ধ রেখেছে। এ ছাড়া শুল্কহার ৫ শতাংশ নির্ধারণ করায় ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও আফ্রিকা থেকে বিপুল পরিমাণ রাবার আমদানি হচ্ছে। এসবের প্রভাবেই মূলত দাম কমছে। তিনি নিজেও রাবারের দাম কমায় ক্ষতিগ্রস্ত। তিনি আরও বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চাউর হয়েছে নাইক্ষ্যংছড়ির বাজারে ১৪০ টাকায় রাবার বিক্রি হচ্ছে। এ কারণে ঢাকার ব্যবসায়ীরাও বেশি দাম দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।
বাংলাদেশ রাবার বাগান ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. কামাল প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে রাবারের দাম ঠিক থাকলেও মাঠপর্যায়ে দাম বাড়ানোর বিষয়ে ব্যবসায়ী-বাগানমালিকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা চলছে।