ওই সব জমি যাঁরা চাষাবাদ করে চলতেন, তাঁদের মধ্য থেকে ১৭২ জন ভূমিহীন কৃষক লিখিত অভিযোগে স্বাক্ষর করেছেন।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের দুর্গম চরে প্রায় ৩০০ একর সরকারি জমি জাল দলিলের মাধ্যমে দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা দখলে জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় শতাধিক কৃষক। ওই সব জমি জেগে ওঠার পর থেকে ভূমিহীন দুই শতাধিক পরিবার চাষাবাদ করে চলত।
গত রোববার ওই পরিবারগুলোর কৃষকেরা গোয়ালন্দ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও গোয়ালন্দ ঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কাছে এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ করেছেন। এ সময় তাঁদের সঙ্গে উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক শামীম মৃধা, উজানচর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
পরদিন সোমবার উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে মাসিক আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বিষয়টি উত্থাপিত হয়। সভায় জেগে ওঠা জমির দখল নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা করা হয়।
উজানচর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান গোলজার হোসেন মৃধা বলেন, ‘এত দিন চরাঞ্চলে জমি দখলের খবর পাইনি। সম্প্রতি চর মজলিশপুর ও পাইকরদিয়া মৌজায় জেগে ওঠা জমিতে একপক্ষ ভুট্টা লাগাচ্ছে, আরেক পক্ষ তুলে নিয়ে আসছে। জমির দখল নিয়ে দুটি পক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের সংঘাত, এমনকি হত্যাকাণ্ডও হতে পারে। ইউএনও এবং ওসিকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানাই।’
লিখিত অভিযোগে ১৭২ জন ভূমিহীন কৃষক স্বাক্ষর করেছেন। তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে কৃষক আক্কাস মাঝি, আবদুর রাজ্জাক খান, লিটন শেখ, নজরুল খাঁসহ কয়েকজন বলেন, চর মজলিশপুর ও পাইকরদিয়া মৌজার অধিকাংশ জমি ১০-১২ বছর আগে জেগে ওঠে। এর মধ্যে প্রায় ৩০০ একর জমির বিশাল চর রয়েছে। এই চরের বনজঙ্গল পরিষ্কার করে, অনাবাদি জমি চাষযোগ্য করে, ফসল ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন স্থানীয় দুই শতাধিক ভূমিহীন পরিবারের সদস্যরা। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জাল কাগজ তৈরি করে এসব জমি বিক্রি করে প্রচুর অর্থ হাতিয়ে ভোগদখলকারী ভূমিহীনদের উচ্ছেদের চেষ্টা করছেন। এমনকি মিথ্যা মামলা দায়ের ও হত্যার হুমকি দিচ্ছেন।
অভিযোগে বলা হয়, উপজেলা আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক মোল্লা বিভিন্ন জাল দলিল তৈরি করে বিক্রি করছেন। জমির জাল দলিল তৈরি করে মানুষকে হয়রানিও করছেন বলে অভিযোগে বলা হয়। রাজ্জাক মোল্লা ছাড়াও গোয়ালন্দ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শহিদুল ইসলাম খান, উপজেলার চরকর্ণেশনা ফকিরাবাদ এলাকার সিদ্দিক মাতুব্বর, ফরিদপুর মমিনখার হাট কছিমদ্দিন ব্যাপারী ডাঙ্গী এলাকার কাদের মোল্লা, ইসমাইল মুন্সীর ডাঙ্গী এলাকার হায়দার মোল্লা, নর্থ চ্যানেল গোলজার মণ্ডলের ডাঙ্গী এলাকার আবুল হোসেন ও মো. হালিম দখলকাজে জড়িত বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব ঘোষ বলেন, গত শনিবার সন্ধ্যায় কয়েক শ লোক দলীয় কার্যালয়ে এ বিষয়ে অভিযোগ করেন। দলের দু–একজন নেতার নাম জড়িত থাকার কথা উঠেছে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাকিস্তান আমলের কিছু কাগজ তৈরি করে ফরিদপুর অঞ্চলের অনেকে ৫০-৬০ বিঘা জমি দখল করে আছেন। কোনো সহিংসতা যাতে না হয়, তা প্রশাসনকে দেখতে তিনি অনুরোধ জানান।
অভিযোগের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কারও জমি দখল করিনি। ওই চরে আমার বাপদাদার প্রায় ২০ বিঘা জমি পড়ে আছে। গত দুই-তিন বছরে সেখানে যাইনি। মিথ্যা অভিযোগ করে মানহানি করায় আমরা তাঁদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিয়েছি।’
আবদুর রাজ্জাক মোল্লা পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, ‘কিছু আওয়ামী লীগ নেতার ইন্ধনে অভিযোগকারী উজানচর ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি জাহিদুল ইসলাম, ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা জিন্দার আলীসহ অনেকে রয়েছেন। তাঁরা কয়েক দিনে ট্রলার ও ঘোড়ার গাড়ি বোঝাই করে প্রায় দুই হাজার মণ ভুট্টা জোড়পূর্বক এনেছেন। এর আগে কৃষক সিদ্দিকের কাছে দুই লাখ টাকা চাঁদাও দাবি করেছিলেন। তাঁরাই দখল-লুটপাট করে আমাদের দোষ দিচ্ছেন।’
আবদুর রাজ্জাকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার সন্ধ্যায় উজানচর ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি জাহিদুল ইসলাম তাঁর সঙ্গে থাকা ফরিদপুরের মাধবদিয়ার বাসিন্দা শফিকুল ইসলামকে দেখিয়ে বলেন, তাঁর কাছ থেকে আট লাখ টাকা নিয়ে ভুয়া কাগজ দিয়েছেন আবদুর রাজ্জাক। আজও তাঁকে জমি বুঝিয়ে দিতে পারেননি। জেগে ওঠা সরকারি খাসজমি তিনি মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে একেকজনকে ৩০-৪০ একর করে লিখে দিচ্ছেন। এত জমি তিনি কোত্থেকে পাচ্ছেন?
বিরোধী দুই পক্ষের উদ্দেশে ইউএনও মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘কাউকে উচ্ছেদের চেষ্টা করলে ফল ভালো হবে না। আমরা শিগগিরই চর এলাকা পরিদর্শন করব। অভিযোগ খতিয়ে দেখে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কী কাগজ আছে, তা যাচাই–বাছাই করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’