সম্ভাবনা থাকলেও পিছিয়ে

বন বিভাগ ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের হিসাবে, ২০২১-২২ অর্থবছরে সুন্দরবনের বাগেরহাট অংশে পর্যটক এসেছেন ১ লাখ ২০ হাজার।

বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় রয়েছে ষাটগম্বুজ মসজিদ।

বাগেরহাটের দক্ষিণে সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগর। জেলাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য পুরাকীর্তি ও প্রত্নতত্ত্ব। আছে মাছ, চিংড়ি, সবজিসহ কৃষিপণ্যের প্রাচুর্য। আরও রয়েছে জেলে, মৌয়াল, কৃষক ও কারুশিল্পীদের বৈচিত্র্যময় জীবনধারা ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। পর্যটন বিকাশের এমন অনুষঙ্গ থাকলেও পিছিয়ে আছে সম্ভাবনাময় এ জেলা।

দীর্ঘদিনেও দর্শনার্থীবান্ধব প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা গড়ে না ওঠায় এ জেলার পর্যটন খাত এখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। এ জন্য সঠিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগের অভাবকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ পরিস্থিতিতে আজ মঙ্গলবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব পর্যটন দিবস।

বাগেরহাট ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক আহাদ উদ্দিন হায়দার বলেন, দেশের তিনটি ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ স্থানের মধ্যে দুটির অবস্থান বাগেরহাটে। একটি প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা সুন্দরবন। অপরটি মধ্যযুগের অন্যতম নিদর্শন ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজসহ মসজিদের শহর বাগেরহাট। পর্যটনশিল্পের বিকাশে প্রথমত বাগেরহাটে একটা মাস্টারপ্ল্যান লাগবে। সেই সঙ্গে পর্যটন স্পটগুলোর আশপাশের মানুষের মধ্যে পর্যটনবান্ধব সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

আহাদ উদ্দিন হায়দার আরও বলেন, ‘আমাদের সমৃদ্ধ বাগেরহাটকে ব্র্যান্ডিংয়ের অভাব রয়েছে। পর্যটকদের কাছে বাগেরহাটের ঐতিহ্য ও প্রকৃতি সঠিকভাবে তুলে ধরতে না পারলে তাঁরা এখানে যেমন অবস্থান করবেন না, তেমনি পর্যটকের আগমন না বাড়লে এখানে বিনিয়োগ, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ এ খাতে সমৃদ্ধি আসবে না।’

সুন্দরবনের প্রধান পর্যটন স্পটগুলো বাগেরহাটের বনাঞ্চলে হলেও এ জেলা শহর থেকে সুন্দরবনে যেতে কোনো ট্যুরিস্ট লঞ্চ বা ট্যুর অপারেটর নেই। প্রায় সব ট্যুর অপারেটরের অফিস খুলনায়। ফলে পর্যটকেরা বাগেরহাটে আসেন কম।

সুন্দরবন অঞ্চলে দীর্ঘ সময় ধরে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণসহায়তা দিচ্ছে পাগমার্ক ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে যখন ট্যুরিজম করতে হয়, তখন কিন্তু কেবল ব্যবসার জন্য ট্যুরিজম করলে হবে না। এখানে প্রকৃতি ও প্রত্নতত্ত্ব দুটোকে নিয়ে যেমন ট্যুরিজম করতে হবে, তেমনি এ স্থানগুলোকে সংরক্ষণ ও বিকাশে কাজ করতে হয়। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। আমরা যেমন দর্শনার্থীদের কাছে স্থানগুলোর গুরুত্ব ও সৌন্দর্য সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারছি না, তেমনি সরকারি পর্যায় থেকে ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে সমন্বয় ও অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত না হওয়াতে এ অঞ্চলের পর্যটনশিল্পের বিকাশ সেভাবে ঘটছে না। এ জন্য সমন্বিত ও কার্যকর কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে।’

বন বিভাগ ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের হিসাবে, ২০২১-২২ অর্থবছরে সুন্দরবনের বাগেরহাট অংশে পর্যটক এসেছেন ১ লাখ ২০ হাজার। একই সময়ে ষাটগম্বুজ মসজিদে এসেছেন ১ লাখ ৮০ হাজার দর্শনার্থী। তবে দর্শনার্থীদের জন্য থাকা-খাওয়া থেকে শুরু করে অন্যান্য সুবিধার অভাব রয়েছে।

ষাটগম্বুজ মসজিদ ও এর প্রতিষ্ঠাতা হজরত খানজাহানের (রহ.) মাজারের কিছুটা পরিচিতি রয়েছে। এর বাইরে ৬০০ বছরের পুরোনো প্রাচীন সড়ক, চুনখোলা মসজিদ বা অন্য স্থাপনাগুলো সম্পর্কে তেমন প্রচারণা নেই। এ বিষয়ে লেখক ও অনুবাদক মোরশেদুর রহমান বলেন, ‘আমরা ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দিই না। এর অন্যতম প্রমাণ বিশ্ব ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদের পাশের একই মহাসড়ক। পৃথিবীর কোথাও এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার মাঝ দিয়ে মহাসড়ক নেই। অধিকাংশ ঐতিহাসিক নিদর্শন অযত্ন ও অবহেলায় নষ্ট ও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। স্থাপনাগুলো রক্ষায় না উদ্যোগ আছে সরকারি পর্যায়ে, না আছে স্থানীয় মানুষের সম্পৃক্ততা।’

বাগেরহাট জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান মো. যায়েদ বলেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সাইটগুলোকে সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য নিয়মিত কাজ করছে। জেলায় অনেক স্থাপনা আছে। এগুলো সম্পর্কে আরও প্রচার-প্রচারণা এবং স্থানীয়ভাবে ট্যুরিস্ট গাইড গড়ে তোলা যেতে পারে। সেই সঙ্গে যাতায়াত–যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নসহ সুযোগ-সুবিধার বিকাশ হলে পর্যটকদের আগমন বাড়বে।

পর্যটকদের আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করতে ২০১৯ সালে প্রায় ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সদর উপজেলার খানজাহানের (রহ.) মাজার মোড়ে তিন তারকা মানের একটি হোটেল নির্মাণ শুরু করে পর্যটন করপোরেশন। তবে তিন বছরেও শেষ হয়নি এর নির্মাণকাজ।

বিষয়টি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন ষাটগম্বুজ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ আক্তারুজ্জামান। তিনি বলেন, শুধু ষাটগম্বুজ নয়, বাগেরহাটে দেখার মতো অনেক স্থাপনা রয়েছে। এগুলো মানুষের কাছে পরিচিত করতে আরও কাজ করা প্রয়োজন।

বাগেরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, ‘যেকোনো অঞ্চলে পর্যটন বেড়ে ওঠে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের হাত ধরে। এরপরই বাইরের উদ্যোক্তারা আসেন। কিন্তু এখানে স্থানীয় উদ্যোক্তা তেমন নেই। ভালো হোটেল, ভালো পরিবহন ও সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য ভালো জাহাজ এখানে নেই। আমরা চেষ্টা করছি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উজ্জীবিত করার জন্য, তাঁরা যেন এগিয়ে আসেন। যদিও তেমন সাড়া মিলছে না।’