ঘূর্ণিঝড় হামুনের দুই ঘণ্টার তাণ্ডবে কক্সবাজারে ৩০ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি-দোকানপাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কয়েক কিলোমিটার বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে, উপড়ে পড়েছে বিদ্যুতের অসংখ্য খুঁটি। হাজার হাজার গাছপালা ভেঙে পড়েছে। গতকাল মঙ্গলবার রাত ৮টা থেকে আজ বুধবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত শহরের বিদ্যুৎ, টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ আছে। বিদ্যুৎ না থাকায় শহর থেকে প্রকাশিত ২০টি দৈনিকের কোনোটিই প্রকাশিত হয়নি। গাছপালা উপড়ে পড়ে শহরের প্রধান সড়ক, সৈকত সড়ক ও কলাতলী সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিদ্যুৎ না থাকায় পুরো রাত অন্ধকারে ডুবে ছিল কক্সবাজার শহর।
জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণকক্ষের তথ্য অনুযায়ী, শহরের বাইরে মহেশখালী ও কুতুবদিয়া দ্বীপে ব্যাপকহারে ঘরবাড়ি ও গাছপালা ভেঙেছে। গাছপালা উপড়ে পড়ে মহেশখালী থেকে শাপলাপুর পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটারের জনতা সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ আছে। গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে উপজেলাগুলোও বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান প্রথম আলোকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় হামুনের আঘাতে কক্সবাজার শহর লন্ডভন্ড হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ–ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় আজ দুপুর ১২টা পর্যন্ত মুঠোফোন ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ আছে। এ কারণে জেলা কার্যালয় থেকে মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। শহরে বিচ্ছিন্ন হওয়া বিদ্যুতের লাইন ঠিক করে সরবরাহ নিশ্চিত করতে আরও এক থেকে দুই দিন সময় লেগে যেতে পারে বলে তিনি জানান।
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, ঘূর্ণিঝড় হামুন গতকাল মধ্যরাতের দিকে আঘাত হানবে বলে বলা হয়েছিল। কিন্তু রাত সাড়ে সাতটার দিকে প্রবল গতিবেগে ঘূর্ণিঝড়টি শহরে আঘাত হানতে শুরু করে। মাত্র দুই ঘণ্টার তাণ্ডবে পুরো শহর লন্ডভন্ড হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়ে এ পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। গাছপালা ও বাতাসে উড়ে আসা ঘরের টিনের আঘাতে অন্তত ২০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলী এলাকার আবদুল খালেক (৪২), মহেশখালীর উপজেলার বড়মহেশখালী ইউনিয়নের গোরস্তানপাড়ার হারাধন দে (৪৫) ও চকরিয়া উপজেলার বদরখালী গ্রামের আশকার আলী (৪৫)। ঘরের দেয়াল চাপা পড়ে আবদুল খালেক এবং গাছচাপায় অপর দুজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। আজ বেলা ১১টা পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড় হামুনের আঘাতে জেলায় কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি জেলা প্রশাসনের দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণকক্ষ।
আজ সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত শহরের প্রধান সড়ক, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, আদালত ভবন, থানা, বাজারঘাটা, আলীর জাহান, বাইপাস সড়ক, কলাতলী, ঝাউতলা, হিলটপ সার্কিট হাউস, উত্তরণ আবাসিক, সার্কিট হাউস সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, পুরো এলাকা ঝড়ে বিধ্বস্ত। সড়কের ওপর পড়ে আছে অসংখ্য গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি। শত শত দোকানপাট-ঘরবাড়ি ভেঙে পড়েছে। অধিকাংশ ঘরের টিনের চাল উড়ে গেছে।
জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে শতবর্ষী একটি বটবৃক্ষ উপড়ে পড়েছে। আদালত ভবন চত্বরে কয়েকটি গাছ উপড়ে পড়েছে, বিদ্যুতের তার ঝুলে আছে সড়কের ওপর। সার্কিট হাউস সড়কের অরুণোদয় স্কুল, জেলা প্রশাসকের ডাকবাংলো ও উত্তরণ আবাসিক এলাকায় শত শত গাছ পড়ে আছে। পৌরসভার লোকজন গাছপালা সরিয়ে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিলেন।
পৌরসভার মেয়র মাহবুবুর রহমান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে পুরো শহর লন্ডভন্ড হবে—এটি কারও মাথায় ছিল না। রাত সাড়ে সাতটা থেকে তীব্রগতির ঘূর্ণিঝড় শহরে আঘাত হানতে থাকে। তখনো প্রচার করা হচ্ছিল ৬ নম্বর বিপৎসংকেত। কিন্তু বাতাসের গতি ছিল তীব্র। রাত ১০টার আগেই পুরো শহরের বিদ্যুৎ, মুঠোফোন ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যায়। সড়কের ওপর গাছপালা পড়ে যান চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। এখন ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের চেষ্টা চলছে। রাত থেকে গাছপালা সরিয়ে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
পৌরসভার তথ্যমতে, ঘূর্ণিঝড় হামুনের তাণ্ডবে পৌরসভার অন্তত ৩০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গাছপালা ভেঙেছে এক লাখের বেশি। রাত সাড়ে নয়টার দিকে পাহাড়তলীতে দেয়াল চাপা পড়ে আবদুল খালেক নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।
পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আকতার কামাল বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে তাঁর ওয়ার্ডে অন্তত দেড় হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে বিলীন হয়েছে অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি। ১ নম্বর ওয়ার্ডের ১২টি গ্রামে বাস করেন অন্তত ৬০ হাজার শ্রমজীবী মানুষ। দেশের শুঁটকি উৎপাদনের প্রায় ৭০০ মহাল এই নাজিরারটেক উপকূলে গড়ে উঠেছে। বেড়িবাঁধ না থাকায় ঘূর্ণিঝড়ে সমুদ্রের পানিতে প্লাবিত হয় এই ওয়ার্ডের ঘরবাড়ি।
জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে বলা হয়, রাতে নাজিরারটেক, ফদনার ডেইল, সমিতিপাড়াসহ বিভিন্ন উপকূল থেকে ৪০ হাজার ১০০ জনকে শহরের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা হয়েছিল। আজ সকালে সবাই ঘরে ফিরে গেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি তালিকা করে সবাইকে ঢেউটিন বরাদ্দ দেওয়া হবে জানিয়ে জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, ‘আমরা দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছি। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। তবে মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, পেকুয়ার বিদ্যুৎ–ব্যবস্থা স্বাভাবিক করতে দু-তিন দিন সময় লেগে যেতে পারে।’
দুর্যোগের সব তথ্য দেয় আবহাওয়া কার্যালয়। রাতের তাণ্ডবে সেই কার্যালয়ও আক্রান্ত হয়েছে। হামুনের তাণ্ডবে শহরের ঝাউতলায় অবস্থিত আবহাওয়া কার্যালয়ের ফটকের পাশে থাকা শিশুগাছটি উপড়ে পড়েছে এবং কার্যালয়ের পাশের বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে পড়েছে। বিদ্যুৎহীন অবস্থায় আছে গুরুত্বপূর্ণ এই কার্যালয়ও। শিশুগাছটি প্রধান সড়কে উপড়ে পড়ায় শহরের ঝাউতলার প্রধান সড়ক দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
কিছুটা দূরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অভ্যন্তরে বেশ কিছু গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়েছে। শহরের বিভিন্ন সড়কে বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব সংস্কার ও ঠিক করতে দু-তিন দিন সময় লেগে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল গণি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাত থেকে বোর্ডের লোকজন মাঠে নেমেছে। যত দ্রুত সম্ভব বিদ্যুতের লাইন ঠিক করার চেষ্টা চলছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। মানবিক সহায়তা হিসেবে কক্সবাজার সদর, রামু, ঈদগাঁও, চকরিয়া, পেকুয়া, কুতুবদিয়া ও মহেশখালীতে ৫০ হাজার টাকা করে সর্বমোট সাড়ে ৪ লাখ টাকা ও ১৪ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পাঁচ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ করা হবে।
কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম বলেন, বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকায় আজ শহর থেকে কোনো দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়নি। শহরের দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ২০।
শহরের লালদিঘি পাড়ের সংবাদপত্র এজেন্ট সৈকত পেপার বিতানের মালিক অর্জুন দাশ বলেন, একমাত্র প্রথম আলো ছাড়া স্থানীয় ও জাতীয় কোনো দৈনিক শহরে আসেনি। বেলা ১১টার আগেই প্রথম আলোর সব কপি বিক্রি হয়ে গেছে।
শহরের এন্ডারসন সড়কের গৃহবধূ তফরিদা খানম বলেন, তাঁর মা ঢাকায় চিকিৎসাধীন। মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় গতকাল রাত থেকে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না তিনি। আজ দুপুর ১২টা পর্যন্ত মায়ের অবস্থাও জানতে পারেননি।
ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন সাংবাদিক ও প্রশাসনের লোকজন। মুঠোফোনের চার্জ শেষ হওয়ায় একে অপরের সঙ্গে জরুরি মুহূর্তের কথাবার্তা ও যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছেন না।