বিভিন্ন হলে পাঁচ শতাধিক আসন অছাত্রদের দখলে। তঁাদের কারণে নতুন শিক্ষার্থীদের হলে তুলতে পারছে না কর্তৃপক্ষ।
ভর্তি পরীক্ষার পাঁচ মাস পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের শুরু হচ্ছে আজ। তবে সশরীর নয়। হলে আবাসনের সুযোগ করে দিতে না পারায় অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। অথচ হলগুলোতে রয়েছে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত অনেক অছাত্র। তাঁদের বের করার তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১৭টি আবাসিক হল চালু রয়েছে। এর বাইরে নবনির্মিত আরও চারটি হল চলতি মাসে উদ্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু নতুন হলে কর্মচারী নিয়োগ না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের ওঠাতে পারছে না বলে দাবি প্রশাসনের।
এসব শিক্ষার্থীকে প্রশাসন কেন হল ছাড়তে বাধ্য করে না। কারণ, প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে তাঁদের ব্যবহার করে।অধ্যাপক পারভীন জলী, ইতিহাস বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয় চলতি বছরের ১৮ জুন, শেষ হয় ২২ জুন। এরপর পাঁচ মাস পার হলেও তাঁদের ক্লাস শুরু করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে বলা হয়েছিল, নতুন হলগুলো চালু করে সেখানে শিক্ষার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করে বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ণ আবাসিক চরিত্রে ফিরিয়ে এনে ক্লাস শুরু করা হবে। এর মধ্যে ২১ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ভর্তি কমিটির এক সভায় ৩০ নভেম্বর থেকে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ভর্তি পরীক্ষার পাঁচ মাস পর অনলাইনে ক্লাস শুরুর ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়ে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়ন সংসদের আহ্বায়ক (একাংশ) আলিফ মাহমুদ বলেন, প্রশাসন ছাত্রলীগের অছাত্রদের বের না করে যারা নতুন শিক্ষার্থী তাঁদের অনলাইনে ক্লাস শুরু করতে যাচ্ছে। এর থেকে আর তামাশার কী হতে পারে।
আবাসন–সংকটের কথা বলে নবীন শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস শুরুর সিদ্ধান্ত নিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। কয়েক বছর আগে পড়াশোনা শেষ হলেও ছাত্র হলগুলোতে পাঁচ শতাধিক আসন দখল করে রাখা হয়েছে। এসব আসন যাঁদের দখলে, তাঁদের বেশির ভাগই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
ইতিমধ্যে প্রাধ্যক্ষ কমিটির সভাপতিকে নির্দেশ দিয়েছি হলে যাতে অবৈধ ছাত্র না থাকে। পরীক্ষানিয়ন্ত্রক থেকে যাদের মাস্টার্স শেষ, তাদের তালিকা পাঠিয়েছি।অধ্যাপক নূরুল আলম, উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ফার্মেসি বিভাগ বাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫ ব্যাচ (২০১৫-১৬ সেশন) পর্যন্ত সব বিভাগেই মাস্টার্স শেষ হয়েছে। ৪৬তম ব্যাচেরও (২০১৬-১৭ সেশন) বেশির ভাগ বিভাগে মাস্টার্স শেষ হয়েছে এবং কয়েকটি বিভাগে পরীক্ষা চলমান আছে। এসব সেশন বাদেও ৪৪ এবং ৪৫ ব্যাচের শতাধিক শিক্ষার্থী আবাসিক হলে আসন দখল করে রেখেছেন। এখনো হলে থাকেন ৪৩ এবং ৪২ ব্যাচের অনেক শিক্ষার্থী। তাঁদের বেশির ভাগই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শৃঙ্খলা–সংক্রান্ত অধ্যাদেশ ২০১৮-এর ৫ (ট) ধারা অনুযায়ী, স্নাতকোত্তর চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা সমাপ্তির সাত দিনের মধ্যে তাঁদের পরিচয়পত্র, চিকিৎসা ও গ্রন্থাগার কার্ড ফেরত দিয়ে নিজ নিজ আবাসিক হল ত্যাগ করবেন। একই ধারায় এ বিধি অমান্য করার শাস্তি হিসেবে উল্লেখ আছে, যারা এ বিধি অমান্য করবেন, তাঁদের ফল প্রকাশ স্থগিত থাকবে।
ছাত্র শৃঙখলা-সংক্রান্ত অধ্যাদেশের এ ধারা মানছেন না ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বর্তমান মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল ৪২ ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান ওরফে লিটন ৪৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী। তাঁদের পড়াশোনা শেষ হলেও দুজনই ভিন্ন হলে চারজনের কক্ষ একা দখল করে থাকেন।
এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটিতে সহসভাপতি রয়েছেন ১০৬ জন। এর মধ্যে অর্ধশতাধিক নেতার ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে। আর যুগ্ম সম্পাদক রয়েছেন ১১ জন, যার বেশির ভাগেরই ছাত্রত্ব শেষ। এ ছাড়া অন্যান্য পদেও অনেক অছাত্র নেতা রয়েছেন, যাঁরা অবৈধভাবে আবাসিক হলে থাকেন।
তবে হলগুলোতে অছাত্র ছাত্রলীগের নেতাদের থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমার জানামতে ছাত্রলীগের যাঁরা হলে রয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই বিভিন্ন কোর্সে ভর্তি আছে। অনেকে স্পেশাল পরীক্ষা দিচ্ছে।’
চলতি বছরের ৭ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব অছাত্র রয়েছেন, তাঁদের সাত দিনের মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন রেজিস্ট্রার রহিমা কানিজ স্বাক্ষরিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সাত দিনের মধ্যে হল না ছাড়লে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ওই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সাত মাস পার হলেও ছাত্র হলগুলোতে ছাত্রলীগের কোনো নেতাকে বের করে দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি।
এ বিষয়ে জানতে উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইতিমধ্যে প্রাধ্যক্ষ কমিটির সভাপতিকে নির্দেশ দিয়েছি হলে যাতে অবৈধ ছাত্র না থাকে। পরীক্ষানিয়ন্ত্রক থেকে যাদের মাস্টার্স শেষ, তাদের তালিকা পাঠিয়েছি। অতি দ্রুত এই সমস্যা সমাধান হবে।’
যতক্ষণ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের আসন ছাড়তে বাধ্য করা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আসনসংকট দূর হবে না বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক পারভীন জলী। তিনি বলেন, ‘হলগুলোতে কয়েক শ আসন প্রভাবাধীন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা দখল করে রেখেছেন, সেটিই অনলাইন ক্লাস শুরু করার পেছনের কারণ বলে মনে করি। এসব শিক্ষার্থীকে প্রশাসন কেন হল ছাড়তে বাধ্য করে না। কারণ, প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে তাঁদের ব্যবহার করে। ভিন্নমত নিয়ন্ত্রণ করতে তাঁদের তারা ব্যবহার করে।’