সিলেটে সড়ক দুর্ঘটনা

পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারীকে হারিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছেন সামছুন্নাহার

সড়ক দুর্ঘটনায় সংসারের উপার্জনকারী একমাত্র ব্যক্তি স্বামীকে হারিয়ে দুই সন্তানকে অসহায় হয়ে পড়েছেন স্ত্রী সামছুন্নাহার বেগম। শুক্রবার বিকেলে
ছবি: প্রথম আলো

দুই চালা টিনের ঘর। ঘরের উঠানে পাঁচটি চেয়ার পেতে রাখা। সেখানে দুই শিশুকে কোলে নিয়ে বসেছিলেন ওয়াহিদ মিয়া (৬৭)। তাঁকে ঘিরে আছেন বিভিন্ন বয়সী লোকজন। সবার চোখে অশ্রু। ঘরের ভেতর থেকে কিছুক্ষণ পরপর আহাজারির শব্দ ভেসে আসছে। ওই ঘর ঘিরে মানুষের ভিড়। আজ শুক্রবার বিকেলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামের মো. কালন মিয়ার বাড়ির চিত্র এটি।

পেশায় সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক কালন মিয়া গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের গোয়াইনঘাটের পিয়াইনগুল কাজী কলিমুল্লাহ উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে দুর্ঘটনায় নিহত হন। মাইক্রোবাসের সঙ্গে অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে কালনসহ সাতজনের মৃত্যু হয়। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ছয়জন অটোরিকশার যাত্রী ছিলেন।

কালন মিয়ার বাড়ির উঠানে চেয়ারে বসেছিলেন তাঁর বাবা শাহজাহান মিয়া (৬৫)। ওয়াহিদ মিয়া তাঁর বেয়াই। জামাতার মৃত্যুতে তিনি মেয়েসহ স্বজনদের সান্ত্বনা দিতে সেখানে যান। কিন্তু কোনো কথা বলতে পারছিলেন না তিনি। এদিকে ছেলে হারানোর শোকে শাহজাহান মিয়াও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন।

প্রতিবেশী ও স্বজনেরা জানান, বয়সের ভারে ন্যুব্জ শাহজাহান মিয়া এখন কাজকর্ম করেন না। অন্যের সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে চালাতেন ছেলে কালন মিয়া। তাঁর আয়েই চলত সাতজনের সংসার। তাঁর মৃত্যুতে বাড়িতে উপার্জনক্ষম কেউ রইল না। কালন মিয়ার দুই ছেলে আবু বক্কর (৫) ও জুনাইদ আহমদ (৩)। বাবা হারানোর দুঃখ তারা এখনো বুঝে উঠতে পারছে না।

কালন মিয়ার স্ত্রী সামছুন্নাহার বেগম (২৮) ঘরেই ছিলেন। স্বজন ও প্রতিবেশীরা তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। কালন মিয়ার মা তাহেরা বেগম (৫৮) ছেলের শোকে কিছুক্ষণ পরপর মূর্ছা যাচ্ছিলেন।

সামছুন্নাহার বেগম বলেন, সংসার আর দুই ছেলে নিয়ে সংসার কীভাবে চলবে—এ নিয়ে তিনি এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন। হঠাৎ কীভাবে কী হয়ে গেল। এমন দিন তিনি দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি। অন্যের সিএনজি ভাড়া নিয়ে তেমন আয় করতে পারছিলেন না কালন মিয়া। ধারদেনা করে একটি অটোরিকশা কেনার পরিকল্পনা করছিলেন। এর মধ্যেই তাঁকে হারাতে হলো। একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন সামছুন্নাহার।

কালন মিয়ার বাড়িতে স্বজনদের সান্ত্বনা দিতে এসেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা ফুরহান আহমদ। তিনি বলেন, পরিবারটি এখন অসহায় হয়ে গেছে। ঘরের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি মারা গেছেন। দুটি শিশুও এতিম হয়ে গেল। বাবার আদর তারা কোনো দিন পাবে না। বিষয়টি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক।

শুধু কালন মিয়ার পরিবার নয়, গতকালের সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সাতজনের মধ্যে পাঁচজনের বাড়ি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায়। এর মধ্যে উত্তর টুকেরগাঁও গ্রামের বাসিন্দা সুরুজ্জামান হারিয়েছেন স্ত্রী ও তাঁর অনাগত সন্তানকে। সুরুজ্জামানের মামা তৈয়ব আলী বলেন, সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের বাগলী গ্রামের রিতা আক্তারকে এক বছর আগে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন সুরুজ্জামান। রিতার পরিবারের সদস্যরা বিয়ে মেনে নিচ্ছিলেন না। সম্প্রতি রিতা সন্তানসম্ভবা জেনে তাঁরা মেনে নেন। বৃহস্পতিবার সকালে তাহিরপুর থেকে রিতার নানা নাতনিকে নিতে এসেছিলেন। পথে দুর্ঘটনায় দুজনই নিহত হয়েছেন।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুসিকান্ত হাজং প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত পাঁচজনেরই বাড়ি কোম্পানীগঞ্জে। উপজেলায় এর আগে একসঙ্গে দুর্ঘটনায় এত মৃত্যুর ঘটনার তথ্য তাঁর জানা নেই। তিনি বলেন, নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার করে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তিনি ওই পরিবারগুলোর প্রতি সমবেদনা জানান।