২৪-এর শহীদদের কারও লাশ উত্তোলন করা যাবে না: সারজিস আলম

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শহীদ পরিবারগুলোকে চেক প্রদান অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন সারজিস আলম। শনিবার দুপুরে রাজশাহী শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে
ছবি: প্রথম আলো

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে কোনো শহীদের লাশ উত্তোলন করা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। আজ শনিবার দুপুরে রাজশাহী শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তার চেক বিতরণ অনুষ্ঠানে তিনি এই মন্তব্য করেন।

সারজিস আলম বলেন, ‘১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তাদের বিচারের জন্য যদি শেখ মুজিবুর রহমানের ডেথ বডি (মরদেহ) উত্তোলনের প্রয়োজন না হয়, তাহলে এই ২৪-এর অভ্যুত্থানে খুনি শেখ হাসিনার হুকুমে এই বাংলাদেশে যারা গণহত্যা ঘটিয়েছে, জীবন নিয়েছে, তাদের বিচারের জন্য কেন শহীদদের লাশ উত্তোলন করতে হবে। ২৪-এর অভ্যুত্থানে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, হত্যা মামলাগুলোর জন্য তাঁদের কারও লাশ উত্তোলন করা যাবে না। আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আমাদের বিচারিক যে মন্ত্রণালয় রয়েছে, সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে একটি কথা বলে দিতে চাই, তাঁরা জীবন দিয়ে নতুন বাংলাদেশ এনে দিয়েছেন, যে ভাইয়ের জীবনের বিনিময়ে আপনি ওই চেয়ারে বসে আছেন। ক্ষতবিক্ষত বুক নিয়ে যে বাবা, মা, ভাই, বোন, সহধর্মিণী বেঁচে রয়েছেন, তাঁদের চোখের সামনে, তাঁদের ওই ক্ষতবিক্ষত কলিজার সামনে আপনারা কোনো দিন চার মাস পর তাঁদের লাশ উত্তোলন করতে পারেন না।’

এ সময় সারজিস আলম পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘যে শহীদ, আহতের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আপনারা উপদেষ্টা, আইজিপি, ডিআইজি, পুলিশ সুপার, বিভাগীয় কমিশনার হয়েছেন, তাঁদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি কীভাবে সম্ভব? চার মাস হয়ে গিয়েছে। আমরা আমাদের জায়গা থেকে কখনো এই বিবেকবোধের পরিচয় দেব না যে এই গণহত্যার সঙ্গে পুরো বাংলাদেশের পুলিশকে জড়িয়ে দেব। কিন্তু এই দায়সারা কথা আমরা বলব না যে, “খুনি হাসিনা হুকুম দিয়েছিল বলে আমি গুলি চালিয়েছি”। খুনি হাসিনা যদি গুলি চালানোর হুকুমও দেয়, তাহলে একজন ব্যক্তি হিসেবে আপনার বিবেকবোধ, দেশের মানুষকে সামনে রেখে যে শপথ নিয়েছিলেন, সেই মনুষ্যত্ব, সেই বিবেকবোধ কোথায় ছিল। যাঁরা ওই বিবেকবোধ দিয়ে ন্যূনতম এই বিচারটুকু করতে পারেননি, যে কতিপয় পুলিশ সদস্য সরাসরি এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন, হত্যাকাণ্ডে যাঁদের সরাসরি ভিডিও, ছবি, ডকুমেন্ট পাওয়া যায়, তাঁদের কেন এখনো বিচার হচ্ছে না।’

খুনের শাস্তি কি বদলি, এই প্রশ্ন তুলে সারজিস আলম বলেন, ‘আজকে আমরা দেখছি, ওই কতিপয় পুলিশদের পোস্টিংয়ের নামে পুরো দেশের বিভিন্ন জায়গায় আবার তাদের কর্মকাণ্ড তারা চালিয়ে যাচ্ছে। খুনের শাস্তি কি এক জেলা থেকে আরেক জেলায় বদলি। এই বাংলাদেশে এখনো দেখতে পাচ্ছি অনেক পুলিশ কর্মকর্তা মামলা নিচ্ছে না, যেসব মামলায় তাদের বিভিন্ন পুলিশের নাম রয়েছে। এই মামলাগুলো নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক নেগোসিয়েশন (দেনদরবার) হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ওই খুনি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের অনেককে টাকার বিনিময়ে, ম্যানপাওয়ারের বিনিময়ে বাঁচানোর জন্য তারা ব্যাকডোরে (পেছনের দরজা দিয়ে) নেগোসিয়েশন করছে। বিভিন্ন জায়গায় মামলা–বাণিজ্য হচ্ছে। এই বাণিজ্যের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী জড়িত আছে, তেমনি প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও জড়িত রয়েছে। পুলিশ সদস্যরাও টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন জায়গায় নেগোসিয়েশন করছে।’

চেক প্রদান অনুষ্ঠানে শহীদ পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলেন সারজিস আলম। শনিবার রাজশাহী শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে

সারজিস আলম বলেন, ‘যারা এই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশের আপনারা যাঁরা জড়িত ছিলেন না, বিচারপ্রক্রিয়ায় যদি সহযোগিতা না করেন, মনে রাখবেন তাঁরা প্রত্যক্ষভাবে ওই খুনের সঙ্গে জড়িত, আর আপনারা পরোক্ষভাবে জড়িত হয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ পুলিশ প্রতিষ্ঠানটির গায়ের প্রতি বিশাল এক কালিমা লেগে গেছে। আপনারা স্বীকার করুন আর না করুন, এই কালো দাগ আপনাদেরকেই মুছতে হবে। আগামী দিনের কাজের মাধ্যমেই মুছতে হবে। যদি না করেন, মানুষের কাছ থেকে কোনো দিনই সম্মান ফিরে পাবেন না। আপনার চেয়ার, পোশাক কোনো দিনই আপনার সম্মান নিশ্চিত করবে না। আমরা এখনো আস্থা রাখতে চাই। আড়াই লাখ পুলিশ পরিবার যদি সৎ হয়, দুর্নীতি না করে, দালাল না হয়, ক্ষমতার তোষামোদী না করে, নিজের চেয়ার ও শপথের মূল্য বোঝে, তাহলে এই বাংলাদেশ আগামী ছয় মাসে অর্ধেক ঠিক হয়ে যাবে। আপনাদের জায়গা থেকে যদি দায়িত্বটা পালন করতে পারেন, এই বিচারপ্রক্রিয়া আগামী এক বছরে যতটুকু চাই, তার অনেকটুকু পূরণ হবে। কোনো রাজনৈতিক দলের দালালি করবেন না। বাংলাদেশের জনগণ যদি দাঁড়িয়ে যায়, আপনার কিছুই করতে পারবেন না।’

সারজিস আলম বলেন, ‘আমরা শুধু বাংলাদেশ পুলিশ নয়, সেনাবাহিনী, অন্তর্বর্তী সরকার, সবাইকে অনুরোধ করতে চাই, আমরা কারও অন্ধ দালাল নই, ক্ষমতাপিপাসু নই। বিবেকবোধের জায়গায় যদি মনে হয়, আপনারা কেউ এই অভ্যুত্থানের স্পিরিটের জায়গার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন, এমনকি প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসও যদি হন, আমরা তাঁকে ছেড়ে কথা বলব না। আমরা বিবেকবোধ বেচে দেওয়া ওই প্রজন্ম নই। বিবেকবোধ বেচা প্রজন্ম হলে আমার পাশে থাকা বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি ভারতের দালালি করতাম। কিন্তু আমরা তা করি না, করব না। আমরা আমাদের জায়গা থেকে স্পষ্ট করে বলেছি, পৃথিবীর যেকোনো দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হবে সমতার, মর্যাদার। কেউ বিন্দুমাত্র ডমিনেট (আধিপত্য) করার চেষ্টা করলে, তার সঙ্গে চোখ রাঙিয়ে কথা হবে, বুলেটের সামনে বুক পেতে দেওয়া হবে।’

এর আগে সকাল ৯টার দিকে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে শহীদ পরিবারের সদস্যরা আসতে থাকেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম উপস্থিত প্রত্যেক শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একে একে কথা বলেন। পরে জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে মঞ্চ অনুষ্ঠান শুরু হয়। ২৪-এর অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর ‘জুলাই অনির্বাণ’ প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। অনুষ্ঠানে রাজশাহী বিভাগের ৬৩ শহীদ পরিবারের মধ্যে ৪৬ পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকার করে চেক দেওয়া হয়।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার খোন্দকার আজিম আহমেদ, রাজশাহী রেঞ্জ ডিআইজি আলমগীর হোসেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক কমিটির সদস্য মেহেরাব সিফাত, মোবাশির উজ জামান, মাহিন সরকার প্রমুখ।