হাজারো সমস্যা নিয়ে বরিশাল সিটি করপোরেশনের পঞ্চম মেয়র হিসেবে আজ মঙ্গলবার দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত। ইতিমধ্যে মেয়াদ শেষ হওয়ার চার দিন আগে গত বৃহস্পতিবার মেয়রের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। নতুন মেয়রকে বরণ করে নিতে নগরজুড়ে চলছে নানা প্রস্তুতি।
নগরবাসীর মন জয়ে নতুন মেয়রকে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বলে মনে করেন নগরের সচেতন নাগরিকেরা। তাঁদের ভাষ্য, বিদায়ী মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর সময়ে নগরে তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। কাঙ্ক্ষিত সেবা পাননি নাগরিকেরা। উপরন্তু গৃহকর, বাণিজ্যিক কর বাড়ানোয় নাগরিকেরা ক্ষুব্ধ হন। ক্ষোভ প্রশমনে নতুন মেয়রকে প্রথমে উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া ‘নতুন বরিশাল’ গড়ার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে তাঁকে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হতে পারে। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও খাল উদ্ধার করে সংস্কারের মাধ্যমে নাগরিকদের দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখাতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) বরিশাল মহানগরের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, গত পাঁচ বছরে সিটি করপোরেশন সরকারি কোনো প্রকল্প পায়নি। কী কারণে, কার ব্যর্থতায় প্রকল্প পায়নি, সেটা নগরবাসীর কাছে তুলে ধরা উচিত। নগরবাসীর তা জানার অধিকার আছে।
২০১৮ সালের অক্টোবরে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেন সাদিক আবদুল্লাহ। কিন্তু গত পাঁচ বছর তিনি সেভাবে নগর ভবনে যাননি। সদর রোডে বিবির পুকুরপাড়ে অ্যানেক্স ভবনে তিনি অফিস করতেন। মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার পর নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে দেশজুড়ে আলোচিত হন সাদিক আবদুল্লাহ। এর মধ্যে ২০২১ সালে সদরের তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সরকারি বাসভবনে তাঁর অনুসারীদের হামলা ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ানোর ঘটনা উল্লেখযোগ্য। পরে বিভাগীয় কমিশনারের মধ্যস্থতায় সমঝোতা হলেও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে তাঁর বিরোধ ও দূরত্ব অব্যাহত ছিল।
নগরের উত্তর কাউনিয়ায় বিসিসির আবাসন প্রকল্পে ২৪০টি প্লট বণ্টনে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। অধিগ্রহণ করা জমির মালিকেরা মামলা করলে হাইকোর্ট প্লটের উন্নয়নসহ সব কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেন। ‘যানজটের নগরী’তে নতুন করে পাঁচ হাজার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার (ইজিবাইক) নিবন্ধন দেওয়া নিয়েও চলছে নানা সমালোচনা। গত ২০ আগস্ট থেকে ইজিবাইকের টোকেন দেওয়া শুরু হয়। টোকেন-বাণিজ্যের সঙ্গে নগরভবনের কয়েকজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা ও বিদায়ী মেয়রের অনুগত কয়েক আওয়ামী লীগ নেতা জড়িত। তাঁরা ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে আবেদন জমা নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
ব্যাটারিচালিত রিকশা-ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের উপদেষ্টা মনীষা চক্রবর্তী বলেন, শেষ বেলায় সাদিক আবদুল্লাহ শ্রমিকদের পকেট কাটার ফন্দি আঁটেন। টোকেনের নামে ইজিবাইকচালকদের বিভ্রান্তিকর একটি সিরিয়াল নম্বর দিচ্ছেন। সিটি করপোরেশনের ব্যাংক হিসাব নম্বরে জমা হচ্ছে ৫ হাজার ৭৫০ টাকা। বাকি টাকা মধ্যস্বত্বভোগীরা লুফে নিচ্ছেন।
মেয়রের পদ ছাড়ার আগে অনুগত কয়েকজনকে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে সাদিক আবদুল্লাহ পদোন্নতি দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাঁর সময় অন্তত ১০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বরখাস্ত ও চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। পরিসংখ্যানবিদ স্বপন কুমার দাসকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা করা হয়েছে। দুজন সহকারী প্রকৌশলীকে নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
চাকরিচ্যুত নির্বাহী প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, পদোন্নতি দিতে ন্যূনতম নিয়মের তোয়াক্কা করা হয়নি। পরিচ্ছন্নতাকর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন বাড়ানো হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে চুক্তিভিত্তিক কর্মীর সংখ্যাও, যাতে নতুন মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার পর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে না পেরে রোষানলে পড়েন।
সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাসের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। নিজের পদোন্নতির বিষয়ে বলেন, ‘নিয়মতান্ত্রিকভাবেই পদোন্নতি পেয়েছি। অনিয়ম হলে তদন্ত সাপেক্ষে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে।’
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, গত আগস্টে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ ফারুক আহমেদকে বদলির পর ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত জাকির হোসেনকে বরিশাল সিটি করপোরেশনে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি যোগদান না করায় ৫ অক্টোবর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের উপসচিব এস এম মুনীর উদ্দীনকে বদলি করে বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা করা হয়। তিনিও এখন পর্যন্ত যোগদান করেননি। এর আগে অক্টোবরে সচিব পদে নিয়োগ পান মাসুমা আক্তার। তিনি ২০ অক্টোবর বাজেট ঘোষণার দিন উপস্থিত হয়ে ৪৫ দিনের ছুটিতে চলে যান। এসব কর্মকর্তাকে ভয়ভীতি দেখানোয় তাঁরা যোগদানে আগ্রহ হারাচ্ছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
খায়ের আবদুল্লাহর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর আমিন উদ্দীন বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন মেয়র যাতে বিপাকে পড়েন, সে জন্য বিদায়ী মেয়র কয়েক মাস ধরে নগরভবনে নানা তৎপরতা চালিয়েছেন। তাঁর অনুগতদের পদোন্নতি দিয়েছেন। সচিব ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা যাতে যোগদান না করেন, সে জন্যও তৎপরতা চালাচ্ছেন। তবে কোনো অপতৎপরতায় কাজ হবে না।
সূত্র জানায়, বরিশালে এখনো সেভাবে শিল্পায়ন হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য, আবাসন, জ্বালানি, প্রযুক্তি ও নির্মাণ খাতে বড় বিনিয়োগ নেই। এ জন্য সিটি করপোরেশনের নিজস্ব আয় কম। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির আয়ের বড় অংশ চলে যায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায়। হাটবাজার, গৃহকর, ট্রেড লাইসেন্স ও অন্যান্য খাত মিলিয়ে করপোরেশনের বার্ষিক আয় ছিল গড়ে ৪০ থেকে ৪৫ কোটি টাকা। কর বাড়ানোর পর গত অর্থবছরে আয় বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য ব্যয় মিলিয়ে খরচের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৪৫ কোটি টাকা।
বরিশালের সাধারণ নাগরিক সমাজের (বসানাস) আহ্বায়ক কাজী মিজানুর রহমান বলেন, নতুন মেয়রকে নাগরিক সেবা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে গৃহকরসহ অন্যান্য পরিষেবা কর সহনীয় পর্যায়ে আনতে উদ্যোগ নিতে হবে।