ভোর থেকে রান্না শুরু করেন বজলুর রহমান। শুক্রবার  রাজশাহী নগরের চৌদ্দপায় এলাকায়
ভোর থেকে রান্না শুরু করেন বজলুর রহমান। শুক্রবার  রাজশাহী নগরের চৌদ্দপায় এলাকায়

পথের ধারে ৪৬ বছর ধরে খিচুড়ি বিক্রি করেন বজলুর রহমান

ভোরে বড় একটি ডেকচি (পাতিল) নিয়ে মাটির চুলায় রান্না শুরু হয়। পাতিলে দেওয়া হয় চালের সঙ্গে পরিমাণমতো নানা পদের ডাল ও মসলা। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রান্না শেষ। আরেকটু সকাল হলেই খাওয়াদাওয়া শুরু হয়ে যায়।

রাজশাহী নগরের চৌদ্দপায় এলাকায় এই খিচুড়ি বিক্রি করেন বজলুর রহমান (৭৭)। ওই এলাকায় তিনি ৪৬ বছর ধরে এই কাজ করছেন। এর মধ্যে প্রতি শুক্রবারে বিশেষ বিরিয়ানিও রান্না করেন তিনি। তাঁর দোকানে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ জন খাবার খান। দোকানটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একেবারে পূর্ব পাশে ঢাকা–রাজশাহী মহাসড়কের পাশে।

বজলুর রহমান অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। তাঁর পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে ছোট ছেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। এখন তিনি চাকরির সন্ধানে আছেন।
বজলুর রহমানের খাবারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, দামে কম, পরিমাণে বেশি, মানেও ভালো পাওয়া যায়। তিনি বর্তমানে এক প্লেট খিচুড়ি ৩০ টাকায়, হাফ প্লেট ২০ টাকায় বিক্রি করেন। সঙ্গে সালাদ হিসেবে দেন শসা ও লেবু। তাঁর রান্না করা খাবার সাধারণত দিনমজুরেরা বেশি খান। কেউ কেউ সকালে এসে তাঁর কাছে খেয়ে কাজে যান। ভোর থেকে শুরু করে সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যেই তাঁর দোকানের সব খাবার শেষ হয়ে যায়। সব মিলিয়ে প্রতিদিন বজলুর রহমান ৩০ কেজি চালের খিচুড়ি রান্না করেন। এই রান্নার দোকানের আয় দিয়ে তাঁর সংসার চলে। আর এই কাজে সহযোগিতার জন্য বাড়িতে তাঁর একজন কাজের লোক আছে।

বজলুর রহমানের দোকানের বসেও খাবার খাওয়ার ব্যবস্থা আছে

গত শুক্রবার ভোরে নগরের চৌদ্দপায় এলাকায় গিয়ে বজলুর রহমানের সঙ্গে কথা হয়। তখন তিনি একটি বড় পাতিল চুলায় দিয়ে আগুন ধরাচ্ছিলেন। প্রতিদিন ফজরের নামাজ শেষে তিনি বাড়ির পাশে থাকা দোকানে আসেন। আগের দিনই বাজার সেরে নেন।

চুলায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল। কথায় কথায় বজলুর রহমান বলেন, তাঁর বাড়ি পাবনার ঈশ্বরদীতে। আইয়ুব খান যখন ক্ষমতায়, তখন তিনি চারঘাট ক্যাডেট কলেজে আসেন। সেখানে এক আত্মীয়ের সরকারি কোয়ার্টারে ছিলেন। তিনি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন। সেই সুবাধে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিকবার চাকরির আবেদন করেন। কিন্তু চাকরি হয়নি। একসময় বিয়ে করেন। পরে খাবার হোটেল খোলেন।
বজলুর জানান, ১৯৭৯ সালে প্রথম বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগার, রাজশাহীর সামনে একটি পাকুড়গাছের নিচে দোকান দেন। সেখানে দীর্ঘদিন দোকান চালিয়ে পরে তা সরিয়ে নিয়ে তার পাশেই দোকান বসান। পরে তিন বছর ধরে তিনি রাস্তার দক্ষিণ পাশ থেকে উত্তর পাশে এসে দোকান দিয়েছেন। তিনি জানান, ৪৬ বছর ধরে ৫০ গজের মধ্যেই তিনি দোকান রেখেছেন। খুব বেশি দূরে যেতে হয়নি। আর বাসাও তাঁর এখানেই।

বজলুর রহমানের খাবারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, দামে কম, পরিমাণে বেশি, মানেও ভালো পাওয়া যায়। তিনি বর্তমানে এক প্লেট খিচুড়ি ৩০ টাকায়, হাফ প্লেট ২০ টাকায় বিক্রি করেন। সঙ্গে সালাদ হিসেবে দেন শসা ও লেবু।

স্মৃতি হাতড়িয়ে বজলুর বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আবু ভাই’ ছিলেন। তিনিই সবচেয়ে পুরনো খাবার দোকান চালানো মানুষ ছিলেন। এরপর বোধহয় তাঁর দোকানই বেশি পুরোনো। তিনি যখন শুরু করেছিলেন, তখন তেমন কোনো খাবারের হোটেল ছিল না। একসময় শিক্ষার্থীরা খুব ভোরে হেঁটে এসে তাঁর খাবার দোকানের খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতেন। আশপাশে বেশকিছু মেস ছিল। মেসের বাসিন্দারাও নিয়মিত ক্রেতা ছিলেন। এখন ছাত্রদের মধ্যে থেকে খুব কমই আসেন। এখন তো বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে প্রচুর খাবার দোকান।

কথা বলতে বলতে বজলুর রহমানের রান্না শেষ হয়। তাঁর স্ত্রী মমতা বেগম শসা ও লেবু নিয়ে হাজির হন। কয়েকজন ক্রেতাও আসেন খাবার নিতে। কয়েকজন পার্সেল করে খাবার নিলেন। আর কয়েকজন খাওয়ার জন্য তাঁর ছোট্ট দোকানটিতে বসলেন। বজলুর নিজেই চুলায় থাকা পাতিল থেকে খাবার তুলে দিলেন।

বজলুর রহমানের দোকান থেকে অনেকে ‘পার্সেল’ করে খাবার নিয়ে যান

দোকানে খেতে বসা মো. ইউসুফ বলেন, ‘আমি তো প্রায় ৩০ বছর ধরে চাচাকে (বজলুর রহমান) চিনি। তাঁর হাতের রান্না খুব ভালো। মাঝেমধ্যে বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এলে এখান থেকেই খাবার কিনে নিয়ে যাই। উনি যে পরিমাণ খিচুড়ি–বিরিয়ানি কম টাকায় দেন, এটা রাজশাহী শহরে আর কেউ দিতে পারবে না।’

রান্না করতে ও মানুষকে খাওয়াতে বজলুর রহমানের ভালো লাগে। তিনি বলেন, ‘অনেকেই বলে আপনার বিরক্ত লাগে না। আমি তখন হেসে বলি, খুব আনন্দ পাই। এটা যে শুধু টাকার জন্যই খাওয়াই, তা নয়। এমন অভ্যস্থতা হয়েছে যে এই মানুষগুলোকে না খাইয়ে থাকতে পারি না।’