সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দুই পা হারিয়েছেন রেবেকা। দুই হাতের ওপর ভর করে চলছেন তিনি। গত সোমবার নিজ বাড়িতে
সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দুই পা হারিয়েছেন রেবেকা। দুই হাতের ওপর ভর করে চলছেন তিনি। গত সোমবার নিজ বাড়িতে

রেবেকা যেন ‘জীবন্ত লাশ’, এখনো খোঁজ পাওয়া যায়নি শাবানার

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসের দিনে ভবনের ষষ্ঠতলায় মায়ের সঙ্গে পোশাকশ্রমিকের কাজ করছিলেন রেবেকা। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৮ বছর। সেদিনের দুর্ঘটনায় ঊরু পর্যন্ত দুই পা হারান তিনি। প্রায় ১১ মাস হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার বারাইহাট চেয়ারম্যানপাড়া গ্রামে বাড়িতে ফেরেন রেবেকা। এরপর কেটে গেছে ১১ বছর। এরই মধ্যে দুই সন্তানের মা হয়েছেন।

এখন কেমন আছেন রেবেকা, জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটা জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছি। মেঘ ডাকার শব্দ, টেলিভিশনে নাটক-সিনেমায় যুদ্ধ-মারামারির দৃশ্য দেখলেই আঁতকে উঠি। কিছু মনে রাখতে পারি না।’ রানা প্লাজা ধসের ভয়াল স্মৃতি এখনো বহন করে চলেছেন উল্লেখ করে রেবেকা জানালেন, স্বামী মোস্তাফিজুর রহমানের সেবা-ভালোবাসা ও সহযোগিতায় হাসিমুখে দিন কাটছে তাঁর। দুই হাতের ওপর ভর করেই ঘর-গৃহস্থালির কাজ করাসহ দেখভাল করছেন মেয়ে সিদরাতুল মুনতাহা (৯) ও ছেলে মাদানী আন্নুর (৫)।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে পড়ে। ওই দুর্ঘটনায় ১ হাজার ১৩৫ শ্রমিক নিহত হন। সেই দুঃখজনক ঘটনার ১১ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ বুধবার। দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের অনেকে এখনো আতঙ্কগ্রস্ত। বেঁচে থাকার তাগিদে কেউ নতুন পথ খুঁজে নিয়েছেন। জীবনযুদ্ধে লড়াই চালিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাঁরা।

সেদিনের ধসে মা চান বানুসহ দাদি, ফুফুকে হারিয়েছেন রেবেকা। তাঁর স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান সাভারে তখন রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। দুর্ঘটনার দিন রানা প্লাজার পাশেই কাজে ছিলেন। খবর পেয়ে প্রথমে স্ত্রীকে ফোন করেন, কিন্তু সাড়া পান না। এরপর ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে। স্ত্রীকে খুঁজে পেতে হন্যে হয়ে ছুটতে থাকেন এদিক-সেদিক। মোস্তাফিজুর বলেন, ‘আল্লাহকে বলেছিলাম জানের বদলে জান দেব, তবু স্ত্রীকে ফেরত দাও। জীবিত অবস্থায় স্ত্রীকে পেয়েছি। আমি নিজেও এতিম, এতিম দেখেই ভালোবেসে বিয়ে করেছি। ওর মুখে হাসি ফোটানোর দায়িত্ব নিয়েছি। অনেকে মনে করেছিলেন, ওকে ছেড়ে আমি চলে যাব। কিন্তু যাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি, তাকে ছেড়ে যাব কীভাবে? ওর জন্য খুব কষ্ট হয়। দূরে কোথাও কাজকামেও যেতে পারি না।’

দুর্ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে রেবেকা পেয়েছেন ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। প্রতি মাসে সেখান থেকে পান ৯ হাজার ১০০ টাকা। সেই টাকায় ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ও সংসারের খরচ চলছে। রেবেকা বলেন, দুর্ঘটনায় যাঁর দুই পা হারিয়েছে, তাঁকে দেওয়া হয়েছে ১৫ লাখ টাকা। এক পা হারালে ১০ লাখ। কিন্তু ভুল প্রতিবেদন দেওয়ায় তিনি এক পা হারানোর ক্ষতিপূরণ ১০ লাখ টাকা পেয়েছেন। স্বামী কাজে যেতে পারেন না। দুই ছেলেমেয়ের জন্য হলেও বাকি ৫ লাখ টাকা তাঁকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানান রেবেকা।

রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় সন্ধান মেলেনি গুলসানে জান্নাত শাবানার। মায়ের ছবি হাতে নিয়ে মেয়ে সোহানা আফরিন

রানা প্লাজার ষষ্ঠতলায় সুয়িং অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন গুলসানে জান্নাত শাবানা (২৭)। পাশেই এনাম মেডিকেলে নিরাপত্তাপ্রহরী হিসেবে চাকরি করতেন তাঁর স্বামী আতাউর রহমান। রানা প্লাজা ধসের ঘটনা চোখের সামনে দেখেছেন আতাউর। দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত ব্যক্তিদের কাছে ছোটাছুটি করেছেন। জীবিত মানুষদের কাছে স্ত্রীর খোঁজ করেছেন। এরপর ১১ বছর কেটে গেলেও স্ত্রী শাবানাকে খুঁজে পাননি আতাউর রহমান।

আতাউর-শাবানা দম্পতির বাড়ি ফুলবাড়ী উপজেলার কাজিহাল ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে। গতকাল মঙ্গলবার আলাপচারিতায় জানান, দুই সন্তান, স্ত্রী আর মাকে নিয়ে তাঁর সংসার ছিল। ছেলেমেয়েকে মায়ের কাছে রেখে ঢাকায় চাকরি করতেন স্বামী-স্ত্রী। ছেলের বয়স তখন ৫ আর মেয়ের ৩ বছর।

আতাউর বলেন, ভবন ধসের ৫ মাস পর এলাকায় ফিরে আসেন। মেয়েটা মায়ের কথা কিছুটা বলতে পারে। মায়ের জন্য প্রথম প্রথম খুব কান্নাকাটি করত। কিন্তু ছেলের তেমন কোনো স্মৃতি নেই। এলাকায় ফিরে সন্তানদের মায়ের কাছে রেখে কৃষিকাজ শুরু করেন। বছর সাতেক আগে মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। সন্তান লালন-পালনে খুব সমস্যায় পড়েন। সন্তানদের কথা চিন্তা করে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন।

নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকায় নাম ছিল শাবানার। স্বামী আতাউর রহমান ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন ১৩ লাখ টাকা। ছেলেমেয়ে নতুন মায়ের কাছে ভালোই আছে উল্লেখ করে আতাউর বলেন, ‘টাকা হয়তো পেয়েছি, কিন্তু ১১ বছরেও স্ত্রীর মরদেহটাও দেখতে পাইনি। মেয়ে সানু এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। ছেলেটাও নবম শ্রেণিতে পড়ছে। ওদের মা বেঁচে থাকলে আজ কত খুশি হতো। কত সুন্দর সংসার ছিল আমাদের,’ বলতে বলতে গলা ধরে আসে আতাউরের।