কক্সবাজারে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির

গোলাগুলি-সংঘর্ষে রাতে ঘুম হয় না, দিনদুপুরেও খুনখারাবি

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোতে প্রায় প্রতিদিন খুনখারাবি, অপহরণ, ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। পরিস্থিতি ক্রমে অবনতির দিকে যাওয়ায় শরণার্থীদের পাশাপাশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন আশ্রয়শিবিরে কর্মরত বেসরকারি সংস্থার কর্মীরা। অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা আশ্রয়শিবিরের বাইরে ছড়িয়ে পড়ায় স্থানীয় লোকজনও আতঙ্কে আছেন।

পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের তথ্য বলছে, গত সাড়ে চার মাসে আশ্রয়শিবিরে ২০টির বেশি সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় ২৬ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ জন রোহিঙ্গা মাঝি, ৭ জন আরসা সন্ত্রাসী। অন্যরা সাধারণ রোহিঙ্গা। আশ্রয়শিবিরে মাদক, অস্ত্র ও সোনার চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) এবং রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন বাহিনী ও মাস্টার মুন্না বাহিনীর মধ্যে এসব ঘটনা ঘটছে।

বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে দেশটির সেনাবাহিনীর নিপীড়নের মুখে। আশ্রয়শিবিরগুলোর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত আছেন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) পৃথক তিনটি ব্যাটালিয়নের ২ হাজার ৩০০ সদস্য।

আশ্রয়শিবিরগুলো পরিচালিত হয় সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের আওতায়। আরআরআরসি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রাতের বেলায় আশ্রয়শিবিরে সন্ত্রাসীদের গোলাগুলি-সংঘর্ষের ঘটনায় সাধারণ রোহিঙ্গারা ঘুমাতে পারছেন না। দিনদুপুরেও খুনখারাবির ঘটনা ঘটছে। সেখানে কাজ করতে যাওয়া এনজিও-আইএনজিওর কর্মীরাও উদ্বিগ্ন। তাঁদের অনেকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার আশ্রয়শিবিরের ১০ জনের বেশি রোহিঙ্গা নেতা, বেসরকারি সংস্থার কর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাঁরা বলছেন, আশ্রয়শিবিরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে হলে সেখানে মাদক, অস্ত্র চোরাচালান রোধ এবং রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে দ্রুত যৌথ অভিযান পরিচালনা জরুরি।

আরআরআরসি মোহাম্মদ মিজানুর রহমানও যৌথ অভিযান চান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশ্রয়শিবিরের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আমরা পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলের সঙ্গে কথা বলছি। আমরা চাচ্ছি যৌথ অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে আশ্রয়শিবিরগুলোকে মাদক, অস্ত্র ও সন্ত্রাসমুক্ত রাখতে।’ তিনি জানান, আশ্রয়শিবিরের চারদিকে দ্রুত কাঁটাতারের বেড়ার নির্মাণকাজ শেষ করা, সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের কার্যক্রম বৃদ্ধি ও গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হচ্ছে।

বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ

৫২টি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) সমন্বিত মোর্চা কক্সবাজার সিএসও এনজিও ফোরামের (সিসিএএফ) কো-চেয়ারম্যান আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, আশ্রয়শিবিরের পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। অপহরণ, ধর্ষণ, খুনোখুনি বেড়ে চলেছে। সেখানে কর্মরত এনজিও-আইএনজিওর কর্মীরা স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারছেন না। নিরাপত্তার কারণে বিকেল চারটার পরপর সবাইকে আশ্রয়শিবির ত্যাগ করতে হচ্ছে। যৌথ অভিযানের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের তৎপরতা নির্মূল করা না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

বাড়ছে খুন, অপরাধ

প্রায় প্রতিদিন আশ্রয়শিবিরগুলোতে গোলাগুলি, সংঘর্ষ লেগে আছে। সর্বশেষ গত বুধবার ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে কুতুপালং আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৫) আরসা ও আরএসওর মধ্যে কয়েক ঘণ্টা ধরে গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন রোহিঙ্গা মাঝি (নেতা) সলিম উল্লাহ (৩৪)।

একই দিন দুপুরে উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৮) আরসা ও আরএসও সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলিতে দুই রোহিঙ্গা শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। উম্মে হাফসা নামের ১১ বছর বয়সী শিশুর কোমরে এবং আট বছর বয়সী আবুল ফয়েজের ডান পায়ে গুলি লাগে। তাদের চিকিৎসা চলছে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে।

উখিয়ার কুতুপালং আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা জালাল আহমদ বলেন, মিয়ানমারের দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং আটটি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনীর কারণে সাধারণ রোহিঙ্গারা শান্তিতে থাকতে পারছে না। দিনের বেলায় এপিবিএন ক্যাম্পে টহল দিলেও সন্ধ্যার পর আশ্রয়শিবির অরক্ষিত হয়ে পড়ে। তখন সন্ত্রাসীদের রাজত্ব শুরু হয়। গভীর রাত পর্যন্ত চলে গোলাগুলি-সংঘর্ষ, অপহরণ ও খুনোখুনির ঘটনা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, আশ্রয়শিবিরে মাদক চোরাচালানের অন্যতম হোতা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন। তাঁর বাহিনীর কয়েক শ সদস্য ইয়াবা, আইস ও সোনার কারবার নিয়ন্ত্রণ করে। শুরুর দিকে আরসার সঙ্গে মিলেমিশে মাদক চোরাচালান করতেন। দেড় বছর আগে রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর আরসা থেকে বেরিয়ে মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ শুরু করে নবী হোসেন। দল ভারী করতে নবী হোসেন কাছে টানেন আরএসওকে। এখন আরএসও এবং নবী হোসেন বাহিনী মিলে আশ্রয়শিবির থেকে আরসাকে উৎখাত করতে মরিয়া।

উখিয়ার ২৬টি আশ্রয়শিবিরের মধ্যে ১৫টির নিরাপত্তা দিচ্ছে ১৪ এপিবিএনের সাত শতাধিক সদস্য। রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। অন্যদিকে ১১টি আশ্রয়শিবিরে নিরাপত্তা দিচ্ছে ৮ এপিবিএনের সমসংখ্যক সদস্য। ১১ আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা থাকেন আরও তিন লাখের বেশি।

আশ্রয়শিবিরগুলোতে এপিবিএনের সদস্যরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টহল ও চৌকিতে তল্লাশি চালান। মাদক, অস্ত্র উদ্ধার ও অপরাধীদের ধরতে অভিযান চালান। কিন্তু সন্ধ্যার পর নিরাপত্তার অভাবে আশ্রয়শিবিরের দুর্গম পাহাড়ের সরু অলিগলিতে টহল পরিচালনা সম্ভব হয় না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির থেকে অস্ত্র ও গুলিসহ প্রায়ই সন্ত্রাসীরা গ্রেপ্তার হচ্ছেন

সম্প্রতি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আরসা ও নবী হোসেন বাহিনীর মধ্যে প্রায়ই মুখোমুখি সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। আরসার উপস্থিতি ও তাদের সন্দেহজনক কার্যক্রমে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে আশ্রয়শিবিরে ২২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২টিতে। ২০২১ সালে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ১৭৩টি। ২০২২ সালে ঘটেছে ৮৬টি।

১৪ এপিবিএন অধিনায়ক ও অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক ছৈয়দ হারুনুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আশ্রয়শিবিরে মিয়ানমারের দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠীসহ কয়েকটি রোহিঙ্গা ডাকাত বাহিনীর সন্ত্রাসীরা খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়েছে। উদ্দেশ্য—আশ্রয়শিবিরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করা। গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি এবং সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

ঝুঁকিতে জননিরাপত্তা

আশ্রয়শিবিরে সাড়ে পাঁচ বছর ধরে স্বাস্থ্য, খাদ্য, শিক্ষা, আবাসনসহ নানা মানবিক সেবায় কাজ করছেন দেশ-বিদেশের শতাধিক সংস্থার ২০ হাজারের বেশি কর্মী। শিবিরে খুনোখুনি, অপহরণের ঘটনা, আরসাসহ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীর হুমকিতে ২০টির বেশি এনজিও আশ্রয়শিবিরে তাঁদের সেবা কার্যক্রম সীমিত রেখেছে। আরও কয়েকটি এনজিও কাজ গুটিয়ে নিচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বেসরকারি সংস্থার প্রধান বলেন, তাঁরা ১১টি আশ্রয়শিবিরে অন্তত সাত হাজার রোহিঙ্গা শিশুকে পাঠদান করেন। কিন্তু প্রতিনিয়ত গোলাগুলি ও খুনোখুনির ঘটনায় শিশুরা কেন্দ্রে আসতে সাহস পাচ্ছে না। শিক্ষকেরাও অনিরাপদ বোধ করছেন।

উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা আবুল কালামের ভাষ্যও একই। আশ্রয়শিবিরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে হলে যৌথ অভিযানের বিকল্প নেই জানিয়ে কালাম বলেন, সে ক্ষেত্রে সাধারণ রোহিঙ্গারাও সন্ত্রাসীদের গতিবিধি সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করবে।

উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আশ্রয়শিবিরের ভেতরে ৪০ হাজারের মতো দোকানপাট রয়েছে। অধিকাংশ দোকানপাটের মালিক রোহিঙ্গারা। সেখানেই চলে মাদকের বেচাবিক্রি। রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবিরের ভেতরে রাখা না গেলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ কোনোভাবে সম্ভব নয়।

মাদকের টাকায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ কিনছে বলে অভিযোগ করেছেন টেকনাফ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল আলম। তিনি আরও বলেন, আশ্রয়শিবির থেকে বেরিয়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা প্রায় টেকনাফের কৃষকদের অপহরণ করে পাহাড়ে নিয়ে বর্বর কায়দায় নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায় করছে। এসব নির্মূলে যৌথ অভিযান দরকার।

জেলার শ্রমবাজার রোহিঙ্গাদের দখলে দাবি করে কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আয়াছুর রহমান বলেন, কাজের সন্ধানে আশ্রয়শিবির ছেড়ে প্রতিদিন কয়েক হাজার রোহিঙ্গা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। অনেকে পাসপোর্ট বানিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। দ্রুত এসব নিয়ন্ত্রণ না হলে জননিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে।