মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের বাঁশতলা গ্রামে শুভ ইসলামের লাউয়ের খেত। ৮ নভেম্বর বিকেলে তোলা
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের বাঁশতলা গ্রামে শুভ ইসলামের লাউয়ের খেত। ৮ নভেম্বর বিকেলে তোলা

সবজি চাষেই তিনি খুঁজে পান জীবনের স্বাদ–স্বাধীনতা

ধানের মাঠ সবুজ হয়ে আছে। বিস্তীর্ণ খেতে উপচে পড়ছে চকচক করা বিকেলের রোদ। খেতের পাশে এখানে-ওখানে মাচায় ঝুলছে লাউয়ের ঝাড়, ছোট-বড় লাউ। বাঁশ ও নীল রঙের প্লাস্টিকের জালে বেড়া দেওয়া খেতে অন্য রকম সবজিও আছে। মনু নদের পাড়ের ভেতরে-বাইরে এ রকম টুকরা টুকরা অনেকগুলো সবজিখেত।

এ রকম সবজিখেতের একজন উদ্যোক্তা মো. শুভ ইসলাম (৩৩)। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের বাঁশতলা গ্রামে মনু নদের পাড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তাঁর সবজির খেত। কোথাও লাউ, কোথাও মিষ্টিকুমড়া, কোথাও শসাখেত। এই সবজিখেতেই এখন তাঁর দিন কাটে। এই সবজি চাষেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন মুক্ত জীবনের স্বাদ–স্বাধীনতা, ইচ্ছেমতো চলার আনন্দ। জীবিকার সহজ নির্ভরতা।

৮ নভেম্বর হেমন্তের এক বিকেল। পশ্চিমে সূর্য ডুবছে। তার মিঠে আলোর রেশ ছড়িয়ে আছে প্রকৃতিতে। মৌলভীবাজার-শমসেরনগর সড়কের মাতারকাপনে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে একটি পাকা সড়ক উত্তরের দিকে চলে গেছে। সেই সড়ক ধরে বাঁশতলার দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে সড়কের দুই পাশে ধানের সবুজে চোখ আটকে পড়ে। শহরের একজন খুচরা সবজি বিক্রেতার কাছ থেকে জানা গেল, বাঁশতলায় অনেকেই সবজি চাষ করেন। এ রকম উদ্যোক্তার মধ্যে শুভ ইসলাম নামের আছেন একজন। সবজির দুর্মূল্যের সময়ে তাঁর খেত থেকে লাউসহ বিভিন্ন সবজি শহরে আসে।

মাঠ পেরিয়ে মনু নদের পাড় ধরে একসময় তাঁর বাড়িতে গেলে, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। তিনি (শুভ ইসলাম) তখন সবেমাত্র খেত থেকে বাড়ি ফিরেছেন। বাড়ির কাজ সেরে আবার খেতে ফিরে যাবেন। সন্ধ্যার অন্ধকার নামলে আবার বাড়ি ফেরা হবে।

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বাঁশতলা গ্রামে শুভ ইসলামের ঝিঙে খেত। ৮ নভেম্বর বিকেলে তোলা

শুভ ইসলাম ঘুরে ঘুরে দেখালেন তাঁর খেতের বিভিন্ন অংশ। বাড়িসংলগ্ন খেতে চাষ করেছেন বাংলা লাউ, ঝিঙে ও করলা। বাংলা লাউয়ের খেতে ছোট-বড় অনেকগুলো লাউ ঝুলে আছে। বড় লাউ বেশি নেই। এগুলো বিক্রি করে ফেলেছেন। পাশেই ছোটখাটো একটি ঝিঙের খেত। তাতে অনেকগুলো ঝিঙে ঝুলে আছে। তার পাশে করলার খেত। অনেকগুলো করলা বিক্রির অপেক্ষায় গাছে ঝুলছে। বাড়ির আরেক পাশে বাংলা লাউয়ের আরেকটি ঝাড়। পরে তাঁর অন্য একটি খেতে নিয়ে গেলেন। মনু নদের পাড় ধরে ওই খেতে গিয়ে দেখা গেছে, একটি খেতে মিষ্টিকুমড়ার ঝাড়ে মাটি সবুজ হয়ে আছে। ওই খেতে এখনো ফল আসেনি। বিচ্ছিন্নভাবে দু–একটা করে কুমড়া ধরেছে। একটু একটু করে বড় হচ্ছে। হলুদ ফুল ফুটে আছে সবুজ পাতার ফাঁক-ফোকরে। পাশেই শসার খেত। সেখানে একজন শ্রমিক কাজ করছেন।

শুভ ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই সবজি চাষ করতে ভালো লাগে। ফসল তুলতে ভালো লাগে। খেতে ফসল দেখতে সুন্দর লাগে। এবার দুই দফা বন্যায় শসা ও মিষ্টি লাউয়ের বেশ ক্ষতি হয়েছে। অনেক ফসল নষ্ট হয়েছে। তারপরও যা হয়েছে, ভালোই হয়েছে।’

শুভ ইসলাম জানিয়েছেন, ২০০৫ সালে একটু বড় পরিসরে বাংলা লাউ চাষ করেছিলেন। সে বছর ৯ হাজার টাকার লাউ বিক্রি করেন তিনি। এই লাউ বিক্রি থেকেই বাণিজ্যিক চাষের সুপ্ত আগ্রহ দানা বাঁধে। কিন্তু বাণিজ্যিক চাষে তখনো যুক্ত হননি। তবে নিজেদের খাওয়ার জন্য নিয়মিতই সবজি চাষ করেছেন। স্কুলে থাকতেই পড়াশোনা বন্ধ করেছিলেন। প্রায় সাত বছর বিয়েসহ বিভিন্ন ইভেন্টে আলোকচিত্রীর (ফটোগ্রাফি) কাজ করেছেন। আলোকচিত্রী হিসেবে তাঁর একটা পরিচিতিও তত দিনে তৈরি হয়ে যায়।

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বাঁশতলা গ্রামে শুভ ইসলামের করলা খেত। ৮ নভেম্বর বিকেলে তোলা

বাবা সিরাজুল ইসলাম সৌদি আরবে থাকতেন। একবার নিজেও সৌদি আরবে যান। প্রায় ছয় মাস সেখানে ছিলেন। ফিরে আসেন দেশে। ২০২২ সালে শুরু করেন বাণিজ্যিক ভাবনা থেকে সবজি চাষ। সাত হাজার টাকা কিয়ার (১ কিয়ার‍=৩০ শতক) হিসেবে প্রায় ৭১ শতক জায়গা ভাড়া নেন। মিষ্টি লাউ ও শসা চাষ করেন। এতে বেড়াসহ প্রায় ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়। পাইকারি দরে বিক্রি করেন ৯০ হাজার টাকার ফসল। বাণিজ্যিক সবজি চাষের সেই শুরু, এটাই এখন চলছে। এবার নিজেদের ও ভাড়ায় নেওয়া প্রায় সাড়ে তিন কিয়ার জমিতে বাংলা লাউ, মিষ্টি লাউ, করলা, ঝিঙে ও শসা চাষ করেছেন। একটু একটু করে তাঁর চাষের বিস্তৃতি ঘটছে।

শুভ ইসলাম জানিয়েছেন, তাঁর উৎপাদিত ফসল শহরের আড়তে নিয়ে বিক্রি করেন। স্থানীয় খুচরা বিক্রেতারাও তাঁর খেত থেকে পাইকারি দরে ফসল কিনে নিয়ে যান। ফসল বিক্রিতে তাঁর কোনো সমস্যা হয় না। বাঁশতলা গ্রামে আগে থেকেই ১০ থেকে ১৫ জনের মতো কৃষক মনু নদের চর, চরসংলগ্ন এলাকার পলিমাটিতে সবজি চাষ করছেন। তবে তাঁর চাষ ও চাষের সাফল্য দেখে আবদুল আলী, জয়নাল মিয়াসহ কিছু নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছেন। তাঁর খেত দেখে নতুন করে সবজি চাষে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে তাঁদের। তিনি খেতে গোবর, ডিএপি, টিএসপি, এমপিও, জিপসামসহ পরিমিত কীটনাশক ব্যবহার করেন। একই সবজি নিজেরাও খেয়ে থাকেন। এই সবজিতে ক্ষতিকর উপাদান মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করেন না।

কৃষি বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তা মাঝেমধ্যে আসেন, খেত দেখে যান। খোঁজখবর নেন। চাষে নতুন করে আর টাকা বিনিয়োগ করতে হচ্ছে না তাঁকে। ফসল বিক্রি থেকেই প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ হয়ে যায়। স্থায়ী শ্রমিক নেই। প্রয়োজনমতো দুই–তিনজন শ্রমিক লাগিয়ে কাজ করিয়ে নেন। বন্যা ছাড়া আর কোনো সমস্যা দেখেন না এই উদ্যোক্তা। স্ত্রী, এক ছেলে নিয়ে যৌথ পরিবার তাঁদের।

শুভ ইসলাম গত শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কৃষি হচ্ছে কাজের মধ্যে ১ নম্বর। এটা একটা স্বাধীন কাজ। আয়ও ভালো হয়। খেত আরও বাড়ানোর ইচ্ছা আছে। আমার দেখাদেখি আরও অনেকে খেত করতে চাইছে, এতে আমার ভালো লাগছে।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মৌলভীবাজারের সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের দায়িত্বে থাকা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা শিপ্রাংশু পাল আজ শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুভ ইসলাম আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে চাষাবাদ করে থাকেন। সব সময় কৃষিতে মালচিংসহ ব্যতিক্রম পদ্ধতি নিয়ে আসেন। বালাইনাশক কম ব্যবহার করেন। উৎপাদন খরচ কমিয়ে চাষ করেন। তাঁর ফসলও ভালো হয়। এ ছাড়া কখন কোন ফসল চাষ করলে ভালো হয়, সেইমতো চাষ করেন। অনেক ফসল আগাম করেন। তাঁর চাষাবাদ দেখে অন্যরাও উৎসাহিত হচ্ছে, উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। আমরা সব সময় তাঁর ফসলের খোঁজখবর রাখছি।’