যশোর-চৌগাছা সড়কে যাত্রীবাহী বাসে প্রায়ই যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। গত তিন বছরে গণপরিবহনে কয়েকটি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাস এলাকাতেও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে। এ অবস্থায় নিরাপদে যাতায়াতের জন্য কয়েক দফা দাবি তুলেছেন শিক্ষার্থীরা।
সর্বশেষ গত রোববার (১২ মে) ক্যাম্পাসে আসার সময় যাত্রীবাহী বাসে যৌন হয়রানির শিকার হন এক ছাত্রী। শিক্ষার্থীরা জানান, ওই দিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস সময়মতো ধরতে না পারায় এক ছাত্রী যাত্রীবাহী বাসে ওঠেন। ওই ছাত্রীর পাশের আসনে মাসুদ নামের এক যুবক বসেন। পথে ওই যুবক ছাত্রীর গায়ে হাত দিয়ে যৌন নিপীড়ন করেন বলে অভিযোগ। এ সময় ওই ছাত্রী চিৎকার দিয়ে প্রতিবাদ করলেও বাসের চালক, সুপারভাইজার, হেলপারসহ কেউ কোনো পদক্ষেপ নেননি। ঘটনার পর ভুক্তভোগী ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির বিচার চেয়ে প্রক্টরের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন।
এ ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন। তাঁরা যৌন হয়রানির ঘটনায় অভিযুক্ত যুবকের শাস্তির দাবি জানান। এ সময় ওই সড়কে কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারেনি।
জানতে চাইলে যশোর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক বলেন, এ ঘটনায় কেউ মামলা করতে আসেননি। মেয়েটির পরিবারের পক্ষ থেকেও মামলা দায়েরে অনাগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে। ওই যুবকের নাম-পরিচয় জানতে পেরেছেন। তাঁর বাড়ি চৌগাছা উপজেলায়। ছেলেটির মুঠোফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ঘটনার পর থেকে সে গা ঢাকা দিয়েছে। তাঁকে আটকে অভিযান চালানো হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রিপা খান প্রথম আলোকে বলেন, যশোর-চৌগাছা সড়কে যাত্রীবাহী বাসে যৌন হয়রানির ঘটনা এটাই প্রথম নয়। গত তিন বছরে যৌন হয়রানির কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ক্যাম্পাসে বহিরাগত যুবকদের দ্বারাও ছাত্রীরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। গত বছর ক্যাম্পাসে আন্দোলনের মুখে এক যুবককে আটক করেছিল পুলিশ।
২০২৩ সালের ৭ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) প্রধান ফটকের সামনে সড়কে বহিরাগত এক ব্যক্তি দুই ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনা জানতে পেরে উত্ত্যক্তকারীদের ধাওয়া করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পরে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সম্মুখে যশোর-চৌগাছা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ এসে তাৎক্ষণিক অভিযান চালিয়ে যশোর সদর উপজেলার সাজিয়ালী গ্রামের বাসিন্দা জিয়ারুল ইসলাম (২৫) নামের এক যুবককে আটক করে।
বাসে প্রায়ই যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে উল্লেখ করে ব্যবস্থাপনা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের আরেক ছাত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে ছাত্রীনিবাসে থাকি। কিন্তু পাবলিক বাসে চড়ে শহরে যাতায়াত করতে হয়। কয়েক মাস আগে আমি নিজেও একবার বাসের ভেতর যৌন হয়রানির শিকার হয়েছি। কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারিনি।’
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যশোর শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরত্ব প্রায় ১৩ কিলোমিটার। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী শহরে বসবাস করেন। তাঁদের যাতায়াতের জন্য সকাল, দুপুর ও বিকেলে নির্দিষ্ট সময়ে কয়েকটি বাস চলাচল করে। অন্য সময়ে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে যেতে চাইলে যাত্রীবাহী বাসের ওপর নির্ভর করতে হয়। এসব বাসে অতিরিক্ত যাত্রী তোলায় দাঁড়ানোর মতো অবস্থা থাকে না। মেয়েদের বসার জন্য নির্দিষ্ট কোনো আসনও নেই। ফলে মেয়েদের দাঁড়িয়ে যাতায়াত করতে হয়। এতে মেয়েরা বেশি হেনস্তার শিকার হন।
এ অবস্থায় গতকালের বিক্ষোভ থেকে বেশ কিছু দাবি তুলে ধরেন শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে রয়েছে—শ্লীলতাহানির ঘটনা সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে অপরাধীর বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি; চৌগাছা বাস মালিক সমিতি নেতাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা; যশোর-চৌগাছা সড়কে সব গণপরিবহনের চালক ও সহকারীকে যাত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা (বিশেষত নারী ও শিশু); গণপরিবহনের সামনের সারিতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আসন নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য বরাদ্দ রাখা; ভবিষ্যতে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে যশোর-চৌগাছা বাস মালিক সমিতিকে এর পূর্ণ দায়ভার নেওয়া ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শহরের মধ্যে প্রতি ঘণ্টায় শাটল বাস সার্ভিস ব্যবস্থা চালু করা।
শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে যেসব দাবি জানানো হয়েছে, এর সবই যৌক্তিক বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আনোয়ার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের সব দাবিই ন্যায্য। গণপরিবহন-সংক্রান্ত সরকারি বিধিতে এসব দাবির কথা বলা আছে। কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। সেগুলো যাতে বাস্তবায়ন হয়, সে বিষয়ে পরিবহন মালিক সমিতির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে।’
চৌগাছা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর বিষয়ে আমরা বিবেচনা করব।’