দাদন নিয়ে ইটভাটার মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন একেকজন শ্রমিক। সাত মাসের জন্য অনেকটা ‘ক্রীতদাস’ হয়ে পড়েন তাঁরা।
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার বেশির ভাগ গ্রাম এবং নিকলী উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের প্রায় ৯০ ভাগ বাড়ি এখন তালাবদ্ধ। ঘরে তালা লাগিয়ে বাড়ির সব নারী-পুরুষ গেছেন ইটভাটায় কাজ করতে। জেলার বিভিন্ন ইটভাটাসহ নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ইটভাটায় বছরের সাত মাস শ্রমিকের কাজ করেন তাঁরা। এই পুরো সময়টা ইটভাটাতেই থাকেন তাঁরা।
হাওর অধ্যুষিত এসব এলাকায় কাজের সুযোগ অনেক কম। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় পরিবারের পুরুষকে। তাই সংসারের অভাব ঘোচাতে এলাকার নারীরা ইটভাটায় কাজ করেন। কাজ করে সন্তানদের ভরণপোষণের পাশাপাশি সংসার চালাতে স্বামীকে সহায়তা করতে পারায় তৃপ্তিও পান তাঁরা। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে হাওরের নারীদের ইটভাটায় জীবন কাটানোর এ ধারা।
তবে সমস্যাও আছে। হাওরের পরিবারগুলো বর্ষার পাঁচ মাস ঘরে বসে কাটাতে হয়। তখন বেশির ভাগ পরিবার সংসার চালাতে ইটভাটার মালিকদের কাছ থেকে আগাম টাকা নেন। একে দাদন বলে। সাত মাসের জন্য দাদন হিসেবে একেকজন ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত ইটভাটার মালিকদের কাছ থেকে অগ্রিম নিয়ে থাকেন। তখন সাত মাস ইটভাটায় কাজ করলেও দৈনিক মজুরি আর পান না তাঁরা। দাদন হিসেবে যে টাকা নেন একেকজন, তা না নিলে দৈনিক মজুরিতে তার দ্বিগুণ টাকা পেতেন তাঁরা। এভাবে ইটভাটার মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন একেকজন শ্রমিক। মন না চাইলেও বাধ্য হয়ে একটানা সাত মাস শ্রমিকের কাজ করে যেতে হয়। অনেকটা সাত মাসের জন্য ‘ক্রীতদাস’ হয়ে পড়েন তাঁরা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, করিমগঞ্জের গুনধর ইউনিয়নের ইন্দা, চুল্লী, ইন্দা উত্তরহাটি, নয়াহাটি; নিকলীর শান্তিপুরসহ কয়েকটি গ্রামের প্রায় ৯০ ভাগ বাড়ি এখন তালাবদ্ধ। এ ছাড়া করিমগঞ্জের উরদিঘী, কন্ডবখালী, ভাটি গাঙাটিয়া, দড়ি গাঙাটিয়া, উজান বরাটিয়া, জলভাঙা, ছনকান্দা, সুলতান নগর, মানিকপুর এবং নিকলীর দিরুয়াইল, সিংপুর, কাশিপুরসহ কয়েকটি গ্রামের কয়েক সহস্রাধিক বাড়িতে তালা লাগিয়ে নারীরা ইটভাটার কাজে চলে গেছেন। সেখানে তাঁরা কার্তিক মাসে গেছেন। সাত মাস কাজ করার পর জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষের দিকে বর্ষার সময় বাড়ি ফিরে আসবেন।
গত রোববার করিমগঞ্জের ইন্দা উত্তরহাটি, নয়াহাটি, চুল্লী ও নিকলীর শান্তিপুর গ্রামে সরেজমিন দেখা যায়, এসব গ্রাম অনেকটা নিস্তব্ধ। গ্রামের প্রায় সব ঘরেই তালা ঝুলছে। শুধু মাঝেমধ্যে দু-একটি বাড়িতে বয়োবৃদ্ধ ও অসুস্থ কয়েকজন লোকের দেখা মেলে।
করিমগঞ্জের ইন্দা উত্তরহাটি গ্রামে কথা হয় সত্তরোর্ধ্ব রাহাতন বেগমের (৭৫) সঙ্গে। তিনি জানান, আগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ইটভাটায় কাজ করতে যেতেন। বয়সের ভারে এখন পারেন না। স্বামী সহর উদ্দিনও মারা গেছেন প্রায় ২০ বছর আগে। তাই তিনি ছোট্ট নাতিদের নিয়ে বাড়িতে আছেন। তিনি বলেন, ‘আমরার গ্রামের বেশির ভাগ বাড়ির ঘরই তালা দেওয়া। ফরিবারের মহিলারাসহ বেহেই ইটখলায় কাম করত গেছেগা। আমার বয়স বেশি হওয়ায় যাইতে পারি নাই। আমার চার ছেরা (ছেলে) ও ছেরাইনতের সব বউয়াইন (পুত্রবধূ) কুমিল্লায় ইটখলায় কাম করতো গেছে। পাশে উরদিঘী গ্রামো মাইয়া হেলেনা খাতুনরে বিয়া দিছি। সেও জামাইরে নিয়ে অহন ইটখলায় কাজ করে।’
শহীদ মিয়া (৫৫) নামে ইন্দা গ্রামের একজন বলেন, তিনি গতকাল তাঁর অসুস্থ মাকে দেখতে নারায়ণগঞ্জের একটি ইটভাটা থেকে দুই দিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসেছেন। তিনি জানান, প্রায় ২০ বছর ধরে তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে ইটভাটায় কাজ করতে যান। একা কাজ করে সংসার চালাতে পারেন না বলে স্ত্রীকে নিয়ে কাজে যান। আগে স্বামী-স্ত্রী একা গেলেও এখন ছেলে–মেয়েদের নিয়ে ইটভাটায় বছরের প্রায় সাত মাস কাটান।
শহীদ জানান, ইটভাটায় নারীরা বেশির ভাগ কাঁচা ইট টানার কাজটি করে থাকেন। এক হাজার ইট টানলে ১৫০ টাকার মতো পান। এভাবে স্বামী-স্ত্রী মিলে সারা দিনে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার ইট টেনে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা উপার্জন করতে পারেন। কিন্তু সাত মাসের জন্য দাদন হিসেবে একেকজন ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত ইটভাটার মালিকদের কাছ থেকে অগ্রিম নিয়ে থাকেন। তখন সাত মাস ইটভাটায় কাজ করলেও দৈনিক মজুরি আর পান না তাঁরা। দাদন হিসেবে যে টাকা নেন একেকজন, তা না নিলে দৈনিক মজুরিতে তার দ্বিগুণ টাকা পেতেন তাঁরা।
একই গ্রামের ললিতা আক্তারের (৫০) স্বামী সিরাজ মিয়ার অস্ত্রোপচার হওয়ায় এ বছর যেতে পারেননি। তাঁর চার ছেলের মধ্যে তিনজনকে বিয়ে করিয়েছেন। তিন ছেলেই বউদের নিয়ে প্রতিবছরের মতো এবারও ইটভাটায় ছেলে-মেয়েসহ চলে গেছেন। বর্ষাকালে ইটভাটার কাজ বন্ধ থাকলে বাড়ি ফিরবেন। ললিতা জানান, ‘আমার এক মেয়ে, সে–ও ইটভাটায় কাজ করে।’
ময়মনসিংহে ইটভাটায় কাজ করেন ইন্দা নয়াহাটির মাহমুদা আক্তার (৪৫)। তিনি মুঠোফোনে বলেন, ‘ফেডের (পেট) জন্য, আবার ইটখলায় (ভাটা) কাম করা জামাইকে সাহায্য আর রান্ধনের কামের জন্য আমরার গ্রামের প্রায় ৯০ ভাগ মহিলা ইটখলায় কাম করে। তবে তাঁরা বেডাইনদের সমান কাম করেও মজুরির টেহা কম পায়। অনেক সময় দেহা যায়, দাদনের টেহা বেডাইনদের বেশি দেওয়া হলেও মহিলাগো দেওয়া হয় কম।’ তাই কাজ করে ন্যায্য পারিশ্রমিকের দাবি জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, ‘সংসার চালাইতে জামাইকে সাহায্য করতে পারায় শান্তি পাই আমরা।’
ইটনা উপজেলার ওকেএম ইটভাটার মালিক মো. ওয়াদুল্লাহ জানান, ইটভাটায় বেশির ভাগ নারীই শুধু কাঁচা ইট গাড়িতে করে টেনে নিয়ে চুলায় রাখেন। ইটভাটার অন্য কাজগুলোর তুলনায় এ কাজে পরিশ্রম কিছুটা কম। একজন নারী চাইলে দিনে অন্তত দুই থেকে তিন হাজার ইট টানতে পারেন। এতে তাঁর ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হয়। তবে অনেকেই কাজ করার আগেই অর্ধেকের বেশি টাকা দাদন হিসেবে নিয়ে যান। কাজ করার সময় তাঁদের টাকা সমন্বয় করা হয়।
স্থানীয় গুনধর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আবু ছায়েম বলেন, তাঁর এলাকার বেশ কয়েকটি গ্রামের কয়েক হাজার নারী ইটভাটার কাজের সঙ্গে জড়িত। পরিবারে সচ্ছলতা আনতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও বাড়িঘরে তালা লাগিয়ে বছরের বেশির ভাগ সময় ইটভাটায় কাটান। পরিবার ও সমাজে গ্রামীণ নারীরা যাতে মর্যাদা পান, সেই প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।