মাগুরায় স্বেচ্ছাসেবক দল নেতাকে পিটিয়ে হত্যা ‘পরিকল্পিত’ বলছেন আওয়ামী লীগের নেতারা

নিহত রিয়াজ মোল্যা
ছবি: সংগৃহীত

মাগুরার মহম্মদপুরে স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতাকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাকে পরিকল্পিত বলছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। তাঁদের অভিযোগ, গ্রাম্য দলাদলি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে স্থানীয় নহাটা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের লোকজন তাঁকে হত্যা করেছেন।

তবে ইউপি চেয়ারম্যান মো. তৈয়েবুর রহমানের দাবি, ঘের থেকে মাছ চুরি করতে গিয়ে এলাকাবাসীর পিটুনিতে ওই যুবকের মৃত্যু হয়েছে।

নিহত মো. রিয়াজ মোল্যা (৩০) মহম্মদপুর উপজেলার নহাটা ইউনিয়নের ফুলবাড়ি গ্রামের নিজাম উদ্দিন মোল্যার ছেলে। তিনি নহাটা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য ছিলেন। গত মঙ্গলবার গভীর রাতে নহাটা ইউনিয়নের ফুলবাড়ি গ্রামে তাঁকে পিটুনি দেওয়া হয়। পরদিন ভোরে তিনি মহম্মদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মারা যান। মৃত্যুর ৫৩ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও এখনো কোনো মামলা হয়নি।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, গ্রাম্য দলাদলিতে রিয়াজ মোল্যা স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি পক্ষের সঙ্গে ছিলেন। গত দুটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক আলী মিয়ার পক্ষে ছিলেন তিনি। গত ইউপি নির্বাচনে সেখানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মো. তৈয়েবুর রহমান চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

পরিবার ও আওয়ামী লীগের একটি পক্ষের অভিযোগ, মো. রিয়াজ মোল্যা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিজের গ্রাম্য দলে ভেড়াতে দীর্ঘদিন ধরে নানাভাবে চাপ দিয়ে আসছিলেন চেয়ারম্যান মো. তৈয়েবুর রহমান।

গতকাল বৃহস্পতিবার সরেজমিনে নিহত রিয়াজ মোল্যার বাড়িতে গিয়ে তাঁর ১৩ বছর, ৮ বছর ও আড়াই বছর বয়সী তিন ছেলেকে দেখা যায়। স্বামী হারিয়ে ভেঙে পড়েছেন তাঁর স্ত্রী শাহানাজ পারভীন। শাহানাজ বলেন, সর্বশেষ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রিয়াজের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। রাতে মুঠোফোনে কল করলেও কথা হয়নি। সকালে হাসপাতাল থেকে অন্য এলাকার এক ব্যক্তির পাওয়া ফোনে তাঁরা জানতে পারেন রিয়াজ মারা গেছেন।
পরিবার জানায়, গত ২৯ অক্টোবর রিয়াজের বড় ভাই শরিফুল ইসলাম ও তাঁর ছেলে জিহাদুল ইসলামকে পুলিশ বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে নাশকতার মামলায় কারাগারে পাঠায়। শরিফুলের স্ত্রী সালমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘২ নভেম্বর আমার ছেলে জিহাদুলের সৌদি আরবে ফ্লাইট ছিল। সেটা ঠেকাতে তুরাপ (তৈয়েবুর রহমানের ডাক নাম) চেয়ারম্যান মিথ্যা মামলায় পুলিশ দিয়ে ধরায়ে দেছে। এই সুযোগে রিয়াজকে তাঁরা শেষ (মেরে ফেলল) করে দিল।’

কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাবাকে হারিয়েছে দুই শিশু। বাবা রিয়াজ মোল্যার মৃত্যুর খবরে বাড়ির অন্যরা যখন আহাজারি করছিলেন, তখনো দুই ভাই দুরন্তপনায় ব্যস্ত। বৃহস্পতিবার মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার ফুলবাড়ি এলাকায়

অভিযোগের বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান মো. তৈয়েবুর রহমান বলেন, মঙ্গলবার রাতে আমীন উদ্দিন নামের এক ব্যক্তির ঘের থেকে রিয়াজ মাছ চুরি করছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে সেখানে দায়িত্বে থাকা নৈশপ্রহরী জসিম উদ্দিন চিৎকার শুরু করলে চারপাশ থেকে লোকজন এসে তাঁকে পিটুনি দেন। রাত ১১টার দিকে নহাটা পুলিশ তদন্তকেন্দ্রে ফোন করলে একজন পুলিশ সদস্য আসেন। পরে নৈশপ্রহরী জসিম উদ্দিন ও ওই পুলিশ সদস্যসহ রিয়াজকে হাসপাতালে নিয়ে যান।

এ ঘটনার পর গতকাল রাতে একটি ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দেখা যায়, মো. রিয়াজ মোল্যা নামের ওই যুবক আহত অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছেন। পাশে পড়ে থাকা একটি বাজারের ব্যাগ থেকে বেশ কয়েকটি তেলাপিয়া মাছ বেরিয়ে আছে। তার পাশে বড়শির মতো কিছু একটা ও পাউরুটি পড়ে আছে। ওই ছবি দেখিয়ে অভিযুক্তরা দাবি করছেন, রাতে ফুলবাড়ি সোয়াদিয়া নামের ওই খালে বড়শি দিয়ে মাছ চুরি করছিলেন রিয়াজ। এ সময় দায়িত্বে থাকা নৈশপ্রহরী তাঁকে ধরে ফেলেন এবং তাঁর চিল্লাচিল্লিতে অন্যরা গিয়ে মারধর করেন।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা কামাল সিদ্দিকী নহাটা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান। নহাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘মাছ চুরির ঘটনা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ, যে খালে মাছ মারার অভিযোগ উঠেছে, ওই খালটি আমাদের নবগঙ্গা নদীর মতো প্রশস্ত। সেখানে রাতের বেলা বড়শি ফেলে এতগুলো তেলাপিয়া মাছ ধরা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আমরা যতদূর জানতে পেরেছি, রিয়াজকে ডেকে নিয়ে প্রচণ্ড মারধর করা হয়েছে। ওই রাতে চেয়ারম্যান (তৈয়েবুর রহমান) নহাটা পুলিশ ক্যাম্পে ফোন করেছিল, কিন্তু ওই ছেলের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে পুলিশ তাকে (রিয়াজকে) গ্রহণ করেনি।’

নহাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ও সাবেক চেয়ারম্যান আলী মিয়া বলেন, ছেলেটাকে নৃশংসভাবে মারপিট করা হয়েছে। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হাড়গোড় গুঁড়া করে দেওয়া হয়েছে। ওই খালের ইজারায় উল্লেখ আছে, কেউ যদি সেখান থেকে মাছ মারে, তবে মালিককে জানাতে হবে। মালিক বসে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। এখানে তাকে যারা ধরেছে বা মারপিট করেছে, তারাই আবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আর মাছ চুরির ঘটনা সাজানো নাটক।
রিয়াজকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করছেন আওয়ামী লীগের এই নেতারা। সেই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছেন তাঁরা।

এদিকে রিয়াজ নিহত হওয়ার ৫৩ ঘণ্টার বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও আজ শুক্রবার বেলা ১১টা পর্যন্ত থানায় কোনো মামলা হয়নি। জানতে চাইলে মহম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. বোরহান উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে মাছ চুরির অভিযোগে ওই যুবককে মারধর করা হয়। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জসিম উদ্দিন নামের একজনকে আটক করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তির পরিবার মামলা দিলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।