খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্টি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক মো. ওয়াসিউল ইসলাম। তিনি সংরক্ষিত এলাকার ব্যবস্থাপনা, প্রকৃতিভিত্তিক পর্যটন, অংশগ্রহণমূলক বন ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করেন। শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেওয়ার আগে তিনি বাংলাদেশ বন বিভাগে সহকারী বনসংরক্ষক (এসিএফ) ছিলেন। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের জিউধারা স্টেশনের আমোরবুনিয়া টহল ফাঁড়ির লতিফেরছিলা এলাকায় লাগা আগুনের বিষয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে তাঁর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন উত্তম মণ্ডল।
গত দুই দশকে ২৫ বার সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। কেন বারবার এ রকম হচ্ছে?
ওয়াসিউল ইসলাম: এ বিষয় নিয়ে বন বিভাগ তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রতিবেদন তৈরি করে। তারা ভালো বলতে পারবে। তবে আমাদের কাছে মনে হয়, মধু সংগ্রহের মৌসুমে মূলত সেখানে আগুনটা বেশি লাগে। মৌয়ালদের মশালের আগুন থেকে এটা লাগতে পারে। আবার যেসব মৌয়াল ধূমপান করেন, তাঁদের অসাবধানতায় আগুনটা লাগতে পারে। অনেকে আবার বলেন, ইচ্ছাকৃতভাবে আগুনটা লাগানো হয়, যাতে অবৈধ ব্যবসায়ীরা বন পরিষ্কার করে মাছ শুকাতে পারেন। বন বিভাগ এটা কখনো স্বীকার করে না, স্বীকার করার কথাও নয়।
আগুন লাগার ঘটনাগুলো কেন বারবার শুধু সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগে ঘটছে?
ওয়াসিউল ইসলাম: আগুন লাগার ঘটনাগুলো মোটামুটি একই জায়গায় ঘটেছে, চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জের কিছু এলাকায়। এর কারণ হচ্ছে, সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগে একসময় নদী খননের নামে খনন করা মাটিগুলো এমনভাবে বনের দুই পাশে রাখা হয়েছে, সেটা একটা বাঁধের মতো হয়ে গেছে। মাটিগুলো যদি বনের লোকালয়ের পাশে রাখা হতো, তাহলে বড় সমস্যা হতো না। তাহলে জোয়ার-ভাটার পানিটা বনের মধ্যে ঢুকতে পারত। বনের যে স্বাভাবিক বৃদ্ধি, সেটা হতে পারত। কিন্তু দুই ধারে মাটি রাখার ফলে জোয়ার-ভাটার পানি বনের ভেতরে যেতে পারছে না। তিন দশক থেকে দেখছি, ওই অংশের বন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জোয়ার-ভাটার পানি না যাওয়া এবং খননের মাটি সেখানে রাখার জন্য বনটা উঁচু হয়ে গেছে। সেখানে ম্যানগ্রোভের জাত কমে গেছে। সেখানে পরবর্তী সময়ে কড়ই, রেইনট্রি—এসব গাছ বনের অংশের মধ্যে লাগানো হয়েছে। যেহেতু সেখানে জোয়ার-ভাটা হচ্ছে না এবং ভূমিটা একবারে শুষ্ক থাকে। বর্ষা মৌসুমের আগে আগে এটা আরও শুষ্ক হয়ে যায়। সে জন্য এখানে আগুন সহজে ধরতে পারে।
আসলে সুন্দরবনের ওই অংশে অপরিকল্পিত নদী খননের কারণে ম্যানগ্রোভের বৈশিষ্ট্য নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। পানির প্রবাহ নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে বন ভরাট করে নদী-খালের পানির প্রবাহ নষ্ট করে দেওয়ায় বারবার আগুন লাগার মতো ঘটনা ঘটছে।
বনের পূর্ব অংশ থেকে পশ্চিম অংশে প্রায় ৩ গুণ বেশি মধু সংগ্রহ করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে মৌয়ালের সংখ্যা বেশি থাকে। কিন্তু সেখানে আগুনের ঘটনা তেমন ঘটে না কেন?
ওয়াসিউল ইসলাম: পশ্চিম বন বিভাগে শুষ্কতা কম। পশ্চিমে মৌচাক বেশি এবং মৌয়ালরা স্বাভাবিক জোয়ার-ভাটা হয়, এ রকম অংশে মধু সংগ্রহ করেন। পূর্ব বন বিভাগে পরিবেশ শুষ্ক, আগেই বলেছি। এ কারণে সেখানে আগুন লাগার ঘটনা বেশি ঘটতে পারে।
আপনি বলছিলেন, সুন্দরবনে অনেক নদী শুকিয়ে গেছে। অনেক নদীতে জোয়ার-ভাটা হচ্ছে না। পানির প্রবাহ না থাকায় ভবিষ্যৎ অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনায় বনকে কতখানি রক্ষা করা যাবে?
ওয়াসিউল ইসলাম: এটি বড় একটা হুমকি। এ জন্য সমন্বিত একটা পরিকল্পনা দরকার। না হলে টেকসই সমাধান পাওয়া যাবে না। এটা শুধু সুন্দরবনের বিষয় না। জাতীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী বিষয়। এবার তিন কিলোমিটার অংশে আগুন লেগেছে। ‘ইকোলজিক্যালি সেনসেটিভ’ জায়গার মধ্যে তিন কিলোমিটার কিন্তু অনেক জায়গা। এই জায়গার মধ্যে যে জীববৈচিত্র্য ছিল, সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হলো। ওটাকে আবার নতুন করে বনায়ন করা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। ভবিষ্যতের উদ্বেগ তো আছেই, বনের মধ্যে পানির প্রবাহ অলরেডি বড় একটা ইস্যু হয়ে গেছে।
এ জন্য বড় ধরনের একটা প্রকল্প দরকার। বাংলাদেশ বন বিভাগের সঙ্গে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের বিভিন্ন শাখা, নদীশাসনের কাজ যারা করে, তাদের সবার একটা সমন্বয় দরকার। একটা পরিকল্পিত পদ্ধতিতে প্রকল্পটা নেওয়া দরকার। কারণ, আগের মতো প্রকল্প নিয়ে যদি মাটি বনের মধ্যে ফেলা হয় এবং বনকে যদি উঁচু করে দেওয়া হয়, তবে ম্যানগ্রোভের জন্য যে পরিবেশ লাগে, সেটা নষ্ট হবে। তখন নতুন প্রকল্পেও কোনো লাভ হবে না।
বনে আগুন নিয়ে সচেতনতার বিষয়ে প্রচারণা কম?
ওয়াসিউল ইসলাম: সচেতনতার বিষয়ে আরও প্রচারণা দরকার। মৌয়াল-বাওয়ালি যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁদের যদি আরও সচেতন করা যায়, তাহলে ভালো হবে। মশাল ব্যবহারে যেন আরও সাবধান হন; কোনোভাবেই বনের মধ্যে যেন ধূমপান না করা হয়, এই সচেতনতাও দরকার। মোটকথা, নানাভাবে এ বিষয়ে প্রচার বাড়ানো জরুরি।
দেখা যায়, বনের আগুন নিভতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। সুন্দরবনের মতো দুর্গম জায়গায় এবং বিশেষ ধরনের এই বনে আগুন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কিছু করা প্রয়োজন?
ওয়াসিউল ইসলাম: সুন্দরবন থেকে অনেক ভেতরে আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে। ফায়ার সার্ভিসের খুব বেশি করণীয় থাকে না। কারণ, তাদের গাড়ি, যন্ত্রপাতি দ্রুততম সময়ে সেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। সেখানে তাদের প্রবেশের সুযোগ কম, সে কারণে তারা দ্রুত কাজ করতে পারে না। এ কারণেই সচেতনতার ওপর বেশি জোর দিতে হবে। তারপরও আগুন লাগার মতো ঘটনা ঘটলে করণীয় কী, সে বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকা দরকার। এ জন্য বন বিভাগের স্পেশাল ইউনিট থাকতেই পারে বা ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে সমন্বিতভাবে তারা কিছু করতে পারে। তবে আগুন লাগার বিষয়ে বন বিভাগের তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ যাতে ঠিকঠাকমতো বাস্তবায়ন করা যায়, সে বিষয়ে বিশেষভাবে জোর দেওয়া উচিত।