কক্সবাজার ও বান্দরবানের সীমান্ত

গোলাগুলির শব্দ থেমেছে, আতঙ্ক কাটেনি

নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তের বিপরীতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পাহাড়ে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর চৌকি। শনিবার সারা দিন চৌকির লোকজন ছিলেন চুপচাপ
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার ও বান্দরবানের তিনটি ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকার মানুষ আজ শনিবার গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাননি। তবে সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু ও বুচিডং শহরের বিভিন্ন পাহাড়ে আরাকান আর্মির সঙ্গে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর তুমুল লড়াই চলছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পাওয়া গেছে।

সীমান্ত সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা একাধিক সূত্র এবং রাখাইন রাজ্যের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই পক্ষের সংঘর্ষ বেড়ে যাওয়ায় মংডু ও বুচিডং এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। শহর দুটিতে লোকসমাগম সীমিত করা হয়েছে। সড়কে টহল দিচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী। এ কারণে সেখানকার দোকানপাট-ব্যবসাকেন্দ্র প্রায় বন্ধ রয়েছে।

এর প্রভাব পড়েছে টেকনাফ স্থলবন্দরেও। পাঁচ দিন ধরে টেকনাফ স্থলবন্দরে মংডু থেকে আমদানি পণ্য বোঝাই কোনো ট্রলার আসেনি। নাফ নদী অতিক্রম করে টেকনাফ ও মংডুর মধ্যে দুই দেশের সীমান্ত বাণিজ্য চালু হয় ১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর।

এদিকে মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যে গোলাগুলি-অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং নাফ নদীতে ডুবোচর সৃষ্টির কারণে নাফ নদী হয়ে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন যাতায়াতের নৌপথে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। প্রতিবছর অক্টোবর মাসে এই নৌপথে নয়টির বেশি জাহাজ চলাচল করত। এখন টেকনাফ ছাড়া পর্যটকবাহী জাহাজ শুধু কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে চলাচল করবে।

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন পাহাড়ে টানা দুই মাস ধরে চলছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘আরাকান আর্মির (এএ) তুমুল সংঘর্ষ। মধ্যখানে দুই দফায় পাঁচ দিন গোলাগুলি বন্ধ ছিল। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। আজ শনিবার সারা দিন গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়নি। তবে রাখাইন রাজ্যের মংডু ও বুচিডং শহরের বিভিন্ন পাহাড়ে আরাকান আর্মির সঙ্গে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর তুমুল লড়াই চলছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পাওয়া গেছে।
ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়া বাজারে ১৮টি হিন্দু পরিবারের বসতি। সেখানে একটি প্রাচীন মন্দির আছে। গোলাগুলির ঘটনায় নিরাপত্তার কারণে প্রশাসন মন্দিরে দুর্গাপূজার আয়োজন নিয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল।

মন্দির কমিটির সভাপতি রূপলা ধর বলেন, সীমান্তে গোলাগুলি কিছুটা কমেছে। তাই আতঙ্ক ছাপিয়ে তাঁরা মন্দিরে আজ শনিবার থেকে সীমিত আকারে দুর্গাপূজা শুরু করেছেন। পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হলে হিন্দুদের ১৪ কিলোমিটার দূরে উখিয়ার বালুখালীতে গিয়ে দুর্গাপূজা করার কথা ছিল।

স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, শুক্রবার রাতেও ঘুমধুমের বাইশফাঁড়ি, তুমব্রু, রেজু, আমতলী, তেঁতুলতলী, ফাত্রাঝিরি, চাকমাপাড়া, পশ্চিমকুল গ্রামের মানুষ মর্টার শেলের গোলার শব্দ শুনতে পান। কিন্তু শনিবার সকাল থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত আর গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়নি।

শনিবার দিনভর উখিয়ার পালংখালী ও টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের লোকজনও গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাননি। তবে সীমান্তের মানুষ আতঙ্কে আছে জানিয়ে হোয়াইক্যং ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, শুক্রবার মধ্যরাতের পারে রাখাইন রাজ্যে ঢেকুবনিয়া, বলীবাজার এলাকায় গোলাগুলি হয়েছে। শনিবার বিকেল পর্যন্ত আরও গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়নি। একই কথা বলেন উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী।

জনপ্রতিনিধিরা জানান, গোলাগুলি চলতে থাকলে হোয়াইক্যং, পালংখালী ও ঘুমঘুম ইউনিয়নের অন্তত ৩১ গ্রামের ৫০ হাজারে বেশি মানুষ আতঙ্কে থাকেন। এ সময় সীমান্ত এলাকার ধানখেত, পাহাড়ের জুমসহ নদীতীরবর্তী চিংড়ি, কাঁকড়া খামারে যাতায়াত বন্ধ থাকে।

জাহাজমালিকদের সংগঠন সি ক্রুজ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের (স্কোয়াচ) সভাপতি তোফায়েল আহমদ বলেন, নাফ নদী দুই দেশের সীমারেখা ভাগ করে দিয়েছে। নাফ নদী হয়েই পর্যটকবাহী জাহাজগুলো সেন্ট মার্টিনে যাতায়াত করে। তা ছাড়া নাফ নদীর বদরমোকামসহ বিভিন্ন পয়েন্টে একাধিক ডুবুচর জেগে উঠেছে। এই পরিস্থিতি ঝুঁকি নিয়ে জাহাজ চলাচল উচিত হবে না। তাই সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে টেকনাফের পরিবর্তে কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম থেকে পর্যটকবাহী জাহাজ সরাসরি সেন্ট মার্টিন দ্বীপ যাতায়াত করবে। তবে মিয়ানমার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আগামী ১ নভেম্বর থেকে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে জাহাজ চলাচল শুরু হবে।

মিয়ানমারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে বন্দরে মংডু থেকে আমদানি পণ্য আসা কয়েক দিন ধরে বন্ধ আছে বলে জানিয়েছেন টেকনাফ স্থলবন্দরের শুল্ক কর্মকর্তা মো. লুৎফুল হক।

টেকনাফ ২ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল শেখ খালিদ মোহাম্মদ ইফতেখার প্রথম আলোকে বলেন, গোলাগুলি-সংঘর্ষ যা হচ্ছে মিয়ানমারের অভ্যন্তরেই হচ্ছে। তবে সীমান্ত অনুপ্রবেশ করে ওপারের কেউ যেন বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে, সে বিষয়ে সতর্ক বিজিবি। সীমান্তে টহলও জোরদার রয়েছে।