ছেলে রিদুয়ানের মৃত্যুতে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা মোস্তাক আহমদ
ছেলে রিদুয়ানের মৃত্যুতে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা মোস্তাক আহমদ

মেয়েদের দেওয়া কথা রাখতে পারলেন না বাবা

দিনমজুর মো. রিদুয়ান (৩৪) যখন সকালে কাজের জন্য বের হচ্ছিলেন, তখন তাঁকে জড়িয়ে ধরে তাঁর প্রাথমিক বিদ্যালয়পড়ুয়া দুই মেয়ে। বাবার কাছে আবদার করে স্কুলের জন্য দুটি নতুন ড্রেস সেলাই করে দিতে। রিদুয়ান আশ্বাস দেন, কাজ থেকে ফিরে স্কুলড্রেস সেলাইয়ের জন্য মেয়েদের দরজিবাড়ি নিয়ে যাবেন। দুই মেয়েকে দেওয়া কথা রাখতে পারেননি তিনি। ঘরে ফিরেছেন ঠিকই, তবে লাশ হয়ে।

আজ বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের কলাতলী এলাকায় পিকনিক বাসের সঙ্গে পিকআপ ভ্যানের সংঘর্ষে নিহত চারজনের একজন রিদুয়ান। তাঁর বাড়ি একই ইউনিয়নের করমুহুরীপাড়ায়।

হারবাংয়ের দরগা গেট এলাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক থেকে পূর্ব দিকে ইট বিছানো সড়ক দিয়ে এক কিলোমিটার গেলেই একটি পাহাড়ের পাশে রিদুয়ানের ঘর। আজ বেলা তিনটার দিকে টিনের ছাউনি দেওয়া চার কক্ষের মাটির ঘরটির সামনে যেতেই ভেসে আসে কান্না আর আহাজারির শব্দ। ঘরের দরজার সামনে খাটিয়ায় রাখা হয়েছে রিদুয়ানের লাশ। সেই লাশকে ঘিরেই আহাজারি করছেন স্বজনেরা। বিলাপ করতে করতে মূর্ছা যাওয়ার দশা রিদুয়ানের স্ত্রী রোকসানা আক্তারের।

রোকসানা বিলাপ করতে থাকেন, ‘আঁর জামাই মরি গিয়ই। আঁর আর কিছু নেই। আঁই দুই মাইয়া লই হডে যাইয়্যুম? আঁর তো বেগ্গিন শেষ।’ (আমার স্বামী তো মারা গেছে। আমার তো আর কিছু নেই। আমি আমার দুই মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাব? আমার তো সব শেষ।)

বারবার মেয়েদের স্কুলড্রেসের কথা বলছিলেন রোকসানা। তিনি বলতে থাকেন, ‘যাইবার সময় হইয়্যেদে ছাদ ঢালাই গরি দুইজ্যা আই যাইবগই। মাইয়্যা দুনুয়ারে স্কুলর ড্রেস সেলাইতো লই যাইবো। এহন, আঁর মাইয়াঅলরে হনে ড্রেস সেলাই দিবো? ইতারা বাপরে হডে পাইবো?’ (যাওয়ার সময় বলেছিল, ছাদ ঢালাইয়ের কাজ শেষ করে দুপুরেই ফিরবে। মেয়ে দুটিকে স্কুলের ড্রেস সেলাই করে দিতে নিয়ে যাবে। আমার মেয়েদের ড্রেস কে সেলাই করে দেবে? বাবাকে কোথায় পাবে তারা?)

রোকসানা যখন বিলাপ করছেন, পাশেই ছিলেন তাঁর শ্বশুর মোস্তাক আহমদ। সন্তানের মুখমণ্ডলে হাত বোলাতে বোলাতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনিও। তাঁকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে দেখা যায় নিহত রিদুয়ানের দুই কন্যা প্রমি আক্তার (১১) ও রিয়া মণিকে (৭)।

মোস্তাক আহমদ বলতে থাকেন, ‘অ পুত তুই আঁরে ফেলাই গিয়সগই। তুর মাও গিয়অই। আঁই হারে লই বাইচ্চুম। অ পুত রে পুত। আঁই হার ঘরত খাইয়্যুম। আঁরে হনে ডাকি ডাকি ভাত হাবাইবো।’ (ছেলেরে, তুইও আমাকে ফেলে চলে গেলি। তোর মা–ও চলে গেছে। আমি কাকে নিয়ে বেঁচে থাকব। আমি কার ঘরে গিয়ে খাওয়াদাওয়া করব। আমাকে ডেকে ডেকে কে আর ভাত খাওয়াবে।)

রিদুয়ানের লাশের পাশে বিলাপরত তাঁর স্ত্রী রোকসানাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা স্বজনদের

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাবা, দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ছিল রিদুয়ানের পরিবার। তাঁর মা দুই বছর আগে মারা গেছেন। মেয়েদের মধ্যে প্রমি আক্তার এলাকার মৌলভী ছাইদুল হক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে এবং রিয়া মণি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।

দিনমজুর রিদুয়ান চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার দরবেশ হাট এলাকায় একটি ভবনের নির্মাণকাজে শ্রমিকদের মাঝি হিসেবে ছিলেন। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে একটি পিকআপ ভ্যানে করে রিদুয়ানসহ অন্য শ্রমিকেরা লোহাগাড়ায় যাচ্ছিলেন। এ সময় একটি পিকনিক বাসের ধাক্কায় রিদুয়ানসহ পিকআপ ভ্যানে থাকা চারজন নিহত হন। নিহত অন্যরা হলেন আবু বক্কর (৩০), মো. জয়নাল (৩৫) ও মহিউদ্দিন (৪৪)। তাঁরাও হারবাং ইউনিয়নের বাসিন্দা।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মহিলা সদস্য রশিদা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, নিহত চারজনের পরিবারই খুবই গরিব। উপার্জনকারী সদস্যকে হারিয়ে এসব পরিবার এখন অনেকটাই দিশাহারা। দুর্ঘটনায় আরও ছয়জন আহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে দুজনের অবস্থা খুবই গুরুতর।