টিনের চালা ফুটো। হালকা বৃষ্টির ফোঁটাতেই ভিজে যায় ঘরের সবকিছু। তাই চালার ওপর দেওয়া হয়েছে ত্রিপল। এরপরও ভারী বৃষ্টিতে চালের ফুটো দিয়ে ঠিকই পানি পড়ে ঘরে। এমনই এক দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে এক বছরের বেশি সময় ধরে নানা রোগে শয্যাশায়ী নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার অম্বর নগর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম। সরকারিভাবে তাঁর জন্য একটি বীর নিবাসের বরাদ্দ হলেও ঠিকাদারকে এক লাখ টাকা ঘুষ না দেওয়ায় তিনি বীর নিবাস তৈরির কাজ শুরু করছেন না। এমন পরিস্থিতিতে হতাশ হয়ে পড়েছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
শুধু বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালামই নন, অম্বর নগর ইউনিয়নের আটজন মুক্তিযোদ্ধার নামে বরাদ্দ হওয়া বীর নিবাস এখন পর্যন্ত কেউই পাননি। আটটির মধ্যে তিনটি বীর নিবাস তৈরির কাজ শুরু হয়েছে প্রায় দেড় বছর আগে। ঠিকাদার কোনোটির ৩০ শতাংশ, কোনোটির ৪০ শতাংশ কাজ করার পর চলে গেছেন। অথচ তিনজন মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যেকের কাছ থেকে রড দিয়ে মজবুত করে কাজ করার কথা বলে নেওয়া হয়েছে ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত। টাকা নিয়েও নির্মাণকাজে ব্যবহার করছেন নিম্নমানের উপকরণ। প্রায় ছয় মাসের বেশি সময় ধরে কাজ বন্ধ রেখেছেন মো. রনি মিজি নামের ওই ঠিকাদার। তাঁকে ফোন করলে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের গালমন্দ করে ফোন রেখে দেন।
গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিনে অম্বর নগর ইউনিয়নের উত্তর অম্বর নগর গ্রামের পশ্চিম পাড়ায় বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মতিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আবদুল মতিনের চৌচালা ভাঙাচোরা টিনের ঘরের সামনের খালি জায়গাতেই নির্মাণ করা হচ্ছিল বীর নিবাস। চার পাশের ও ভেতরের দেয়ালে ইটের গাঁথুনি আংশিক শেষ করা হয়েছে। এখনো রয়ে গেছে বাকি দেয়ালের ইটের গাঁথুনি, ছাদ তৈরি, দরজা জানালা, টয়লেট, রান্নাঘরের কাজ।
প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে ৭৬ বছর বয়সী এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘জীবনসায়াহ্নে এসে স্বপ্ন দেখেছিলাম, সরকারের দেওয়া উপহারের ঘরে শেষনিশ্বাস নিতে পারব। কিন্তু সেটি বোধ হয় আর হচ্ছে না। প্রায় ছয় মাস ধরে ঠিকাদারের কোনো খোঁজ নেই।’ কাজ শুরু করার সময় তাঁর কাছ থেকে এক লাখ টাকা নিয়েছেন ঠিকাদার। কিন্তু এখন ঠিকাদারের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না। এমন পরিস্থিতিতে স্ত্রী, চার ছেলে, ছয় মেয়ে নিয়ে ভাঙা ঘরে অনেক কষ্টে থাকছেন। বৃষ্টি হলে টিনের চালার ছিদ্র দিয়ে পানি পড়ে।
একই ইউনিয়নের পূর্ব অম্বর নগর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তারও থাকেন একচালা একটি আধা পাকা টিনের ঘরে। ঘরটি অনেক পুরোনো হওয়া ওপরের চাল নষ্ট হয়ে গেছে। আবদুস সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, অর্থের অভাবে টিনের ওপর ত্রিপলও দিতে পারেননি। তবু ধারদেনা করে ঠিকাদারকে ১ লাখ ৫১ হাজার টাকা দিয়েছেন বীর নিবাস তৈরির জন্য। তাঁর পুরোনো বাড়ির সামনের শেষসম্বল জমিটুকু দিয়েছেন বীর নিবাস তৈরির জন্য। ঠিকাদার কাজ শুরু করেছেন গত বছরের মার্চ মাসে। প্রায় ২০ শতাংশ কাজ করার পর ঠিকাদারের আর দেখা নেই। প্রায় আট-নয় মাস ধরে ঠিকাদারকে ফোন করলেও ফোন ধরেন না। ধরলেও উল্টো গালমন্দ করেন।
আবদুস সাত্তার কষ্টের কথা বলতে বলতে একপর্যায় কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ দেশ স্বাধীন করেছি। কখনো কেউ চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস পায়নি। আজ এই ঘরের উসিলায় নাতির বয়সী ঠিকাদারের কাছ থেকে গালমন্দ শুনতে হয়। ঘরের কাজটুকু শেষ করে দেওয়ার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হয়। এর চেয়ে কষ্টের আর অপমানের কি হতে পারে? একমাত্র শেখ হাসিনাই মুক্তিযোদ্ধাদের কথা ভাবেন, আর কেউ না।’
প্রায় একই কথা বললেন পূর্ব অম্বর নগরের আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ উল্যাহও (৭৫)। তাঁর কাছ থেকে দুই দফায় ১ লাখ ৫ হাজার টাকা নিয়েছেন ঠিকাদার রনি। তবে বাড়ি অসমাপ্ত রেখেই ঠিকাদার চলে গেছেন। চারপাশের ও ভেতরের কক্ষের দেয়ালে ইটের গাঁথুনিও এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। রয়ে গেছে ছাদসহ অন্য সব কাজ। মোহাম্মদ উল্যাহ জানান, তিন-চার মাস ধরে ঠিকাদার লাপাত্তা। ফোন করলে ফোন ধরেন না। নির্মাণকাজে ব্যবহার করেছেন পুরোনো ব্যবহৃত ইটের কংক্রিট ও নিম্নমানের বালু। এসবের প্রতিবাদ করেও কোনো কাজ হয়নি। সরকারি কোনো প্রকৌশলীও কখনো কাজ দেখতে আসেননি। তাই ঠিকাদার তাঁর ইচ্ছামতো কাজ করছেন।
এক লাখ টাকা দিতে না পারায় বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এম শাহজাহানের বীর নিবাসের কাজও শুরু করেননি ঠিকাদার। পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হওয়ায় ঠিকমতো হাঁটতেও পারেন না এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। থাকেন একটি জরাজীর্ণ পুরোনো ঘরে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। কখনো ভাবিনি কোনো কাজে ঘুষ দিতে হবে। কিন্তু নিজের স্বাধীন করা দেশের ঠিকাদার তাঁর কাছে এক লাখ টাকা দাবি করেছেন। টাকা না দিলে বীর নিবাস তৈরির কাজ তিনি করবেন না।
অভিযোগের বিষয়ে জানার জন্য ঠিকাদার মো. রনি মিজির মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার ফোন দিয়ে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তাই অভিযোগের বিষয়ে তাঁর বক্তব্য জানা যায়নি। পরে কথা হয় বীর নিবাস নির্মাণ প্রকল্পের তদারকির দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী মো. অলি উল্লাহর সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সোনাইমুড়ীতে বীর নিবাস তৈরির কাজ নিয়ে তিনি নিজেই হতাশ। ১০৬টি বীর নিবাস তৈরির কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। কোনোটির এখনো চূড়ান্ত বিল পরিশোধ করার অবস্থা হয়নি।
অলি উল্লাহ বলেন, ঠিকাদার রনি যে কয়টি ঘরের যতটুকু পরিমাণ কাজ শেষ করেছেন, এর একটি বিল তাঁকে এরই মধ্যে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এরপরও তিনি বাকি কাজ করছেন না। বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) জানেন। আর কাজ শুরুর আগে তিনি (ঠিকাদার) বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়ে তিনি অবগত নন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কানিজ ফাতেমা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এই কর্মস্থলে এসেছেন পাঁচ মাস। এসেই মুক্তিযোদ্ধাদের বীর নিবাস নির্মাণ নিয়ে ঠিকাদারের টালবাহানার বিষয়টি নিয়ে অবগত হন। তাৎক্ষণিক তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক, প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। চেষ্টা করছেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাজগুলো শেষ করার জন্য। ইউএনও জানান, সোনাইমুড়ীতে ১০৬টি বীর নিবাসের মধ্যে ৩৬টির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। তবে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়নি। আর ৩৬টির নির্মাণকাজ এখনো শুরু হয়নি। বাকি ঘরগুলোর নির্মাণকাজ চলমান।