‘জ্বালানি তেল, নাইয়া-মাঝির খাবারদাবার মিলাই বিশ-তিরিশ হাজার টাকার মাল সাগরে পাডায়। আট-দশখান ইলিশ লই আইলে আর কি খরচা উডে? উল্টা দিন দিন ক্ষতি। কোও দিন গা-গা (সমান–সমান), কোনো দিন বিস্তর লস।’
সন্দ্বীপের বাংলাবাজার ঘাটের বোটমালিক মো. ফসিউল আলম এভাবেই বলছিলেন তাঁর হতাশার কথা। এই হতাশা তাঁর একার নয়, বেশি লাভের আশায় বেশি বিনিয়োগ করে ক্ষতির মুখে পড়েছেন সন্দ্বীপের শত শত ইলিশ ব্যবসায়ী, জেলে ও নৌকার মালিক। ইলিশ ধরার জন্য অনেকে ৩০-৩৫ লাখ টাকা খরচ করে নৌকা-ট্রলার নামিয়েছেন সাগরে। বিনিয়োগকারীদের অনেকেই বলেন, এই বিপুল বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ কী, তাঁরা জানেন না। ধারদেনা ও ঋণ পরিশোধের উপায় দেখছেন না তাঁরা।
গত শুক্রবার সন্দ্বীপের সবচেয়ে বড় ইলিশের মোকাম ধুরখাল ও গাছতলী ঘাটে ইলিশের জন্য বিকেল চারটা থেকে ব্যাপারীরা ঘাটে ভিড় করতে শুরু করেন। পাঁচটা নাগাদ বোট থেকে নামতে শুরু করে ইলিশ। চাহিদার তুলনায় কম থাকায় পণ (৮০টি) হিসেবে ইলিশ বিক্রি করা হয়। ১ কেজি বা তার বেশি ওজনের প্রতি পণ ইলিশ ব্যাপারীরা কিনেছেন ১ লাখ টাকায়। মাঝারি (৬০০ গ্রামের বেশি) সাইজের ইলিশের পণ ৮০ হাজার টাকায়; অর্থাৎ পাইকারি দরে প্রতিটির দাম পড়ছে ১ হাজার টাকা।
দক্ষিণে ভাসানচর–সংলগ্ন সাগরে ইলিশ আহরণে যায় সন্দ্বীপের নৌকাগুলো। ১০ জন নিয়ে দুই দিন সাগরে থেকে ৩০টি ইলিশ নিয়ে ফিরেছেন নাজিম উদ্দিন (৩৮)। সব মিলিয়ে ইলিশের দাম উঠেছে ২২ হাজার টাকা। নাজিম জানান, দুই দিনে জ্বালানি ও খাবার মিলিয়ে তাঁর খরচও পড়েছে প্রায় সমান–সমান। ফলে চড়া দামে ইলিশ বিক্রি করেও কোনো লাভ থাকছে না।
সন্দ্বীপের দক্ষিণে সাগরে এবং পশ্চিমাংশে মেঘনার মোহনায় ছোট-বড় সাতটি ঘাটে ইলিশ ধরা হয়। বর্ষার আগে আগেই জাল, বোট, বয়া, কাছিসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে ইলিশ আহরণকারীরা প্রস্তুতি শুরু করেন। তখন থেকে জনপ্রতি ২৫-৩০ হাজার টাকা দাদনের বিনিময়ে লোকবল নিয়োগ করেন তাঁরা। হাতিয়া, সুবর্ণচর, কোম্পানীগঞ্জ থেকে মাঝিদের মাধ্যমে এসব লোকজন নিয়ে আসা হয়। বেশির ভাগ বোট তৈরিতে খরচ পড়ে ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা। অনেকে ৩০-৩৫ লাখ টাকার বোটও নামান। এ ছাড়া আছে স্থানীয় জলদাস সম্প্রদায়ের বিন্দি জাল ও টিন জাল। সেগুলোতেও মাঝারি থেকে ছোট আকৃতির ইলিশ ধরা পড়ে।
গাছতলী ঘাটের দোকানি মো. সাইফুল ইসলাম (৪০) এ বছর দুটি নৌকায় ১৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এর মধ্যে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা দাদন দিয়ে তিনি ২০ জন মাঝি নিয়োগ দিয়েছিলেন। তিন দফা সাগরে দুটি নৌকা পাঠিয়ে ইলিশ পেয়েছেন মাত্র ১৪টি। এই অবস্থায় দাদন নেওয়া কর্মীরাও তাঁকে ছেড়ে যান। সাইফুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ধারকর্জ করে সুদের ওপর টাকা নিয়েছি। কোনো টাকাই ওঠাতে পারিনি। টাকা ফেরত দেওয়ার চিন্তায় ঘুম নাই আমার।’
ধুরখালে ইলিশের কারবারি রহিম উল্লা বলেন, ‘তেত্তিয়া সনে (তিন বছর আগে) ইলিশে জাল ভর্তি অই যাওনের ফলে জাল কেটে দেওয়া লাগছে! এত মাছ নিয়ে জাল তোলা যাইতেছিল না। আর এই বছর গোটা জাল খালি!’ সাত দিন সাগরে গিয়ে ৩টি ইলিশ পেয়েছেন সাইফুল মাঝি (৩২)। জাল জোড়াতালি দেওয়ার কাজ করতে করতে তিনি বলেন, ‘ভালো কোনো লক্ষণ নাই; কিন্তু এখনো খরচ করে যাইতেছি।’
সন্তোষপুর বটগাছতলা ঘাটের মো. রাসেল জানান, ‘সব মিলিয়ে আমার খরচ পড়েছে সাড়ে চার লাখ টাকা। এখনো পর্যন্ত লাভের মুখ দেখি নাই। এভাবে চলতে থাকলে ৫ লাখ টাকার বেশি ক্ষতি হবে আমার।’
গত দুই যুগ ধরে ইলিশ ধরছেন গাছলতলীর বসু সেরাং। প্রথম আলোকে তিনি জানিয়েছেন, সন্দ্বীপে ইলিশ মারার বোটের সংখ্যা ২৫০ এর বেশি হবে। এবার সবাই মোটা অঙ্কের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। তিনি জানান, প্রতি দুই দিনে তাঁর ক্ষতির পরিমাণ ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ‘এ বছর কোনো মাছই নেই সাগরে, গত বছর কিছুটা ছিল। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমরা এ পেশায় টিকতে পারব না।’
কূল থেকে চর পড়ে যাওয়া, পলি সঞ্চয়ের ফলে সাগরে পানির গভীরতা কমে যাওয়াসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ইলিশ কমছে বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন সন্দ্বীপ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আতিকুল্লাহ। সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা শিল্পের দূষণকেও তিনি ইলিশ কমে যাওয়ার কারণ বলে উল্লেখ করেছেন।
স্থানীয় জেলে, মাঝি ও বোটের মালিকেরা মনে করেন, কূল থেকে সাগরের গভীরের দিকে চর পড়ে যাওয়ায় ইলিশ কমেছে। তাঁরা গত শীতে নুনা (জেলি ফিশ) আসার কথা বলেছেন। গবেষকদের মতামত, জেলি ফিশের দেখা মিললে সেখানে অন্য মাছ দ্রুত কমতে থাকে। তবে মাঝিরা অভিযোগ করেন, চাঁদপুর বা রামগতি থেকে আসা রকেট বোটের লোকেরা কারেন্ট জাল বিছিয়ে সাগরের এই এলাকাকে মাছশূন্য করে ফেলেছেন।