বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিতে গত ৫ আগস্ট বাসা থেকে বের হয়ে যান কামাল হোসেন (২৬)। পরদিন সকালে তাঁর দগ্ধ লাশ পাওয়া যায় ঢাকার ধানমন্ডিতে। তাঁর পরনে থাকা গেঞ্জির পেছনে ‘কামাল’ নামটি লেখা ছিল। সঙ্গে থাকা মুঠোফোন থেকে সিম বের করে স্থানীয় একজন পরিবারকে কল করে মৃত্যুর খবর দেন।
নিহত কামাল হোসেন ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার রাজীবপুর ইউনিয়নের খুলিয়ারচর গ্রামের কৃষক হাশিম উদ্দিনের ছেলে। ছয় ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন কামাল। তাঁর মায়ের নাম মজিদা খাতুন। দুই বছর আগে কামাল বিয়ে করেন নোয়াখালী জেলার শারমিন আক্তারকে। ঢাকার লালবাগ কবরস্থান এলাকায় স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন কামাল। সেখানে একটি হোটেলে রান্নার কাজ করতেন তিনি। আবার কখনো রিকশাও চালাতেন।
নিহত কামালের বড় ভাই লিটন মিয়া বলেন, ‘৬ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে কামালের খবর পাই। একজন ফোন করে জানান, কামালের লাশ পড়ে আছে। লাশটা যখন পাই, তখন পুড়ে সেদ্ধ অবস্থায় আছিল। শরীর কালো হয়ে গেছিল। মুখও কিছুটা নষ্ট হয়ে গেছিল। চেহারা দেখে চেনার কোনো উপায় আছিল না। কিন্তু তাঁর পরনের গেঞ্জির পেছনে নাম লেখা ছিল। তার গেঞ্জি, প্যান্ট, মোবাইল দেখে আমরা চিনতে পারি।’
লিটন মিয়া বলেন, তাঁরা শুধু লাশ পেয়েছেন। কামাল কীভাবে মারা গেছেন, কেউ কিছু বলতে পারেননি। সেখান থেকে লাশ সরাসরি বাড়িতে নিয়ে আসেন। কোনো ময়নাতদন্ত হয়নি।
স্বজন ও পরিবার সূত্রে জানা যায়, অভাবের কারণে কামাল পড়ালেখা করতে পারেননি। সংসারের হাল ধরতে ১৫ বছর ধরে ঢাকায় হোটেলে রান্নার কাজ করছিলেন তিনি। নিজে পড়ালেখা না করতে পারলেও ছোট ভাই হাদিস মিয়াকে নরসিংদীতে কওমি মাদ্রাসায় পড়াচ্ছিলেন। সেখানে একটি মাদ্রাসায় কিতাব বিভাগে পড়লেও কামাল মারা যাওয়ায় পড়ার খরচ দিতে পারবেন না বলে তাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছেন বাবা। ছোট বোন আলিফা খাতুনকে স্থানীয় একটি মহিলা মাদ্রাসায় পড়ার খরচ দিচ্ছিলেন কামাল।
৬ আগস্ট সন্ধ্যায় ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার কাঁচামাটিয়া নদীর পাশে খুলিয়ারচর জামে মসজিদের মাঠের কোণে কামালের লাশ দাফন করা হয়। বুধবার কবরের পাশে গিয়ে পাওয়া যায় তাঁর বাবা হাশিম উদ্দিনকে। বৃষ্টির পানিতে কবরের মাটি দেবে যাওয়া নিয়ে চিন্তিত তিনি। হাশিম উদ্দিন বললেন, ‘আমার পোলার শরীরে কোনো আঘাত ছিল না। শুধু শরীর সেদ্ধ হয়ে গেছিল।’
এই পোলা আমার কইলজার গোরদা আছিন। সংসারি হেই দেখশন করত। হেই পোলাই আমার শেষ অইয়া গেল।মজিদা খাতুন, নিহত কামালের মা
মানুষের জমিতে দিনমজুরি করতেন হাশিম উদ্দিন। ছেলের কথা মনে করে ঢুকরে কেঁদে তিনি বলেন, ‘ছেলে আমারে কইতো, “কাজকাম ছাইড়্যা ঠিকমতো নামাজ পড়বা, মসজিদে যাইবা, চিল্লায় যাইবা। ছোট ভাই-বোনদের মাদ্রাসার পড়ার খরচ ও সংসারের সব খরচ আমি দিমু।” কিন্তু আমার সেই ছেলেই চইল্যা গেল। ছেলের কথা মনে অইলে জীবনডা বাইরইয়্যা যায়।’ সরকারের কাছে তিনি ছেলে হত্যার বিচার চান।
নিহত কামালের মা মজিদা খাতুন আহাজারি করে বলেন, ‘এই পোলা আমার কইলজার গোরদা আছিন। সংসারি হেই দেখশন করত। হেই পোলাই আমার শেষ অইয়া গেল।’