ঢাকার অদূরে সাভারের আশুলিয়ায় গতকাল সোমবার পোশাকশ্রমিকদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, সংঘর্ষ, ভাঙচুর ও শ্রমিক হতাহতের ঘটনায় ৩৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছেন যৌথ বাহিনীর সদস্যরা।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের আজ মঙ্গলবার দুপুরে আদালতে পাঠানো হলে আদালত তাঁদের কারাগারে পাঠিয়ে দেন। আশুলিয়া থানা-পুলিশ জানায়, গতকাল আশুলিয়ার টঙ্গাবাড়ি এলাকায় শ্রমিকদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, সংঘর্ষ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় রাতে আশুলিয়া থানা-পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ জনকে আসামি করে মামলা করে। রাতে আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালায় যৌথ বাহিনী। অভিযান চালিয়ে ৩৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আশুলিয়ার টঙ্গাবাড়ি–মাদবরবাড়ি এলাকায় মণ্ডল নিট ওয়্যারস লিমিটেড নামের পোশাক কারখানায় ১ হাজার ২০০ শ্রমিক কাজ করেন। কিছুদিন ধরে বিভিন্ন দাবিতে তাঁদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হলে গত ২৮ সেপ্টেম্বর কর্তৃপক্ষ শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে। তবে শ্রমিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল কারখানা খুলে দেওয়া হয়। সকালে যথাসময়ে শ্রমিকেরা কাজে যোগ দিলেও ৮টা ২০ মিনিটের দিকে তাঁরা কাজ বন্ধ করে বিভিন্ন স্লোগান দিতে শুরু করেন। এ সময় শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে সেনাবাহিনী, শিল্প পুলিশ, জেলা পুলিশসহ বেশ কয়েকজনের উপস্থিতিতে শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠক করা হয়। বৈঠক চলাকালে ‘কর্তৃপক্ষ দুই শ্রমিককে গুম ও দুজনকে ধর্ষণ করেছে’ বলে গুজব ছড়ানো হয়। এ ছাড়া পাশের ন্যাচারাল ডেনিমস লিমিটেড ও ন্যাচারাল ইন্ডিগো লিমিটেডের শ্রমিকেরাও কর্মবিরতি শুরু করেন। বেলা ১১টার দিকে কারখানা দুটিতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এ সময় কারখানা দুটির অজ্ঞাত শ্রমিকেরা মণ্ডল নিট ওয়্যারস লিমিটেডের দিকে যাওয়ার সময় পথে ম্যাংগো টেক্স লিমিটেডের কিছু শ্রমিককেও বাইরে বের করে আনেন।
এজাহারে আরও বলা হয়েছে, ওই তিনটি কারখানার শ্রমিকেরা বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে মণ্ডল নিট ওয়্যারস লিমিটেডের সামনে আসেন। তাঁরা মণ্ডল নিট ওয়্যারসের শ্রমিকদের যৌথ বাহিনী আটকে রেখেছে বলে গুজব ছড়িয়ে দেন। এ সময় উচ্ছৃঙ্খল কিছু শ্রমিক ও বহিরাগত ব্যক্তিরা মণ্ডল নিট ওয়্যারসের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। তবে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের বোঝান, ভেতরে কেউ আটক নেই। শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। এ সময় যৌথ বাহিনীর সদস্যরা তিনটি কারখানার শ্রমিকদেরই বিশৃঙ্খলা তৈরি না করে সেখান থেকে সরে যেতে অনুরোধ করেন। তবে এ অনুরোধ উপেক্ষা করে শ্রমিকেরা যৌথ বাহিনীর ওপর ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করেন। দুপুর ১২টার দিকে তাঁদের সঙ্গে বহিরাগত ব্যক্তিরাও যোগ দেন। এ সময় উচ্ছৃঙ্খল শ্রমিকেরা ইট-পাথর, রড, লাঠিসোঁটা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে যৌথ বাহিনীর ওপর হামলা করেন। এতে শিল্প পুলিশ সুপার (এসপি) সারোয়ার আলমসহ র্যাব-৪-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আক্তারুজ্জামান মাথায় আঘাত পান। এ ছাড়া যৌথ বাহিনীর ১০ থেকে ১২ জন সদস্য গুরুতর আহত হন।
উচ্ছৃঙ্খল শ্রমিকেরা শিল্প পুলিশ-১-এর একটি লেগুনা, রিকুইজিশনের একটি বাস, র্যাবের দুটি পিকআপ ও সেনাবাহিনীর চারটি জিপ, একটি ট্রাক ও দুটি পিকআপ ভাঙচুর করেন। উচ্ছৃঙ্খল শ্রমিকেরা আশপাশের পোশাক কারখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সড়কে চলাচলকারী যানবাহনে হামলা চালালে শিল্প পুলিশ-১ ও ঢাকার স্ট্রাইকিং-৫ ডিউটিতে নিয়োজিত সদস্যরা সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়েন। সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিক মো. কাউসার খান আহত হলে তাঁকে দ্রুত এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান বলে জানতে পারে পুলিশ। এ ঘটনায় শ্রমিক রাসেল মিয়া, নয়ন, ওবায়দুল ও নাজমুল হোসেনকে একই হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন মো. সাফওয়ান (২১), মো. ওমর ফারুক (২৬), মো. মিনাজুল আরেফিন (২৬), মো. মাসুদ রানা (২৫), অশোক কুমার সিংহ (৪২), মো. অপু (২৫), মো. বাদল হোসেন, আপন চন্দ্র (২০), মো. মাজাহারুল ইসলাম (২২), মো. আশিকুর রহমান (৪০), মো. নাছির উদ্দিন (২৬), মো. হাসান আলী (২৯), মো. সাইদুল ইসলাম (২১), মো. মনোয়ার হোসেন (৩২), আব্দুল জলিল (১৯), মো. আজীজুল ইসলাম (৪২), মো. মামুন (১৯), মো. রামীম (১৯), মো. কফিল রানা (৩২), মো. শাহাদাত হোসেন, (২০) মো. হাসানুর রহমান (২১), মো. নাইমুল ইসলাম (২৪), মো. আল আমিন (২৪), আল ইমরান (২৯), আবু তৈয়ব (৩০), মো. সুজিত (২৮), মো. ইদ্রিস (২৩), মো. জাহিদুল ইসলাম (২২), মো. ওমর ফারুক (৩১), মো. শাকিল হোসেন (২৫), মো. মুরাদ হোসেন (৩১), মো. সুমন (২২), মো. গোলাম রাব্বী (২৪), আ. রাকিব (২৪), আল আমিন (২৯) ও মো. আনিস খন্দকার (২৪)।
আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আবু বকর সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল টঙ্গাবাড়ি এলাকায় দায়িত্ব পালনরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব পালনে বাধা, ভাঙচুর, একটি কারখানায় হামলা, শ্রমিক হতাহতের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। ওই মামলায় ৩৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে যৌথ বাহিনী। আজ দুপুরে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।