নদীর বুকে ইলিশ ধরছিলেন জেলেরা
নদীর বুকে ইলিশ ধরছিলেন জেলেরা

অভয়াশ্রমে কমেছে ইলিশের আনাগোনা, মৌসুম শেষে দেনায় আছেন জেলেরা

ইলিশের প্রজনন ও অভয়াশ্রমের মধ্যে অন্যতম পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলা-সংলগ্ন তেঁতুলিয়া নদী। তবে এই নদীতে চার-পাঁচ বছর ধরে আশঙ্কাজনক হারে ইলিশের আনাগোনা কমছে। এ বছরও কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে ইলিশ পাওয়া যায়নি। ফলে দুশ্চিন্তা ও হতাশার মধ্যেই শেষ হচ্ছে এবারের ইলিশ ধরার মৌসুম। মৌসুমের শেষে হিসাবের খাতায় দাদন ও ঋণ বেড়েছে জেলেদের। ঋণের টাকা পরিশোধ নিয়ে তাই তাঁদের বেশ দুশ্চিন্তা।

ইলিশের প্রজনন মৌসুম শুরু হয়েছে। এ কারণে মা ইলিশ রক্ষায় গত শনিবার মধ্যরাত থেকে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়েছে। আবার নভেম্বর থেকে শুরু হবে জাটকা না ধরার জন্য ২৪০ দিনের (আট মাস) নিষেধাজ্ঞা। সেই নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পরপরই শুরু হবে সাগরে সব ধরনের মাছ না ধরার জন্য ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা।

মাছ ব্যবসায়ী ও জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর এই তিন মাস ইলিশের মৌসুম। জেলেরা সারা বছর ধরে এ মৌসুমের অপেক্ষায় থাকেন। আগে এ সময় তেঁতুলিয়া নদীতে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ত। তবে চার-পাঁচ বছর ধরে তা অনেকটাই কমেছে। এ কারণে হতাশ বাউফল উপজেলার ছয় হাজারেরও বেশি জেলে।

কাঙ্ক্ষিত ইলিশ না পাওয়ায় মৌসুমে শেষে ঋণ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন একই এলাকার জেলে মো. রফিক (৩৮)। তিনি বলেন, আড়তদারের কাছ থেকে ২ লাখ টাকা ও এনজিও থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। ইলিশের মৌসুম শেষে তা সুদে-আসলে পরিশোধ করার কথা ছিল। তবে মৌসুম শেষে হিসাবের খাতায় কোনো লাভ হয়নি। বেড়েছে দেনা। কীভাবে এ দেনা পরিশোধ করবেন, তার কোনো উপায়ও দেখছেন না।

বাউফলে ২০ জন আড়তদার আছেন। তাঁদের হিসাব অনুযায়ী, আড়তে এ বছর জুলাই মাসে আনুমানিক ৩৬ মেট্রিক টন, আগস্টে ৪৪ মেট্রিক টন ও ভরা মৌসুম সেপ্টেম্বরে ৫২ থেকে ৫৩ মেট্রিক টন ইলিশ এসেছে। চলতি অক্টোবর মাসে ইলিশের পরিমাণ অনেক কম। ২০টি আড়তে প্রতিদিন ৬০০ কেজিরও কম ইলিশ এসেছে। অথচ গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে এসেছিল ৫৫ থেকে ৬০ মেট্রিক টন ইলিশ। আর চার বছর আগে এর পরিমাণ ৭০ থেকে ৮০ মেট্রিক টন।

মো. জুয়েল মৃধা (৩৮) নামে একজন আড়তদার প্রথম আলোকে বলেন, চার-পাঁচ বছর আগে জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়ত ঝাঁকে ঝাঁকে, আকারেও বড় ছিল। আর এখন সংখ্যায় ইলিশের পরিমাণ কম এবং আকারেও আগের তুলনায় অনেক ছোট।
জেলেদের ভাষ্যমতে, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে নিম্নচাপের কারণে সাগর উত্তাল থাকায় তাঁরা আশানুরূপ ইলিশ ধরতে পারেননি। একাধিকবার বঙ্গোপসাগরে গিয়েও অনেক জেলে খালি হাতে ফিরে এসেছেন। ইলিশের প্রজনন ও অভয়াশ্রম তেঁতুলিয়া নদীতে তেমন মাছ না থাকায় হতাশ তাঁরা।

এ বছর সাগরে ও নদীতে ইলিশ মাছ ধরার খরচ বাবদ আড়তদারের কাছ থেকে ৪ লাখ দাদন নিয়েছিলাম। ব্যাংকঋণও আছে ৮০ হাজার টাকা। যা মাছ পেয়েছি তা বিক্রি করে খরচ দিয়ে সমান সমান। ঋণের বোঝা মাথাই রয়েই গেছে।
শহিদ মোল্লা, জেলে

নিমদী গ্রামের জেলে মো. সোহেল ব্যাপারী (৩৫) বলেন, মৌসুমের শুরুর দিকে আহরণ করা ইলিশেও তেমন দাম পাওয়া যায়নি। সেপ্টেম্বরের শেষ ও অক্টোবরের শুরুর দিকে মাছের দাম বাড়লেও নদীতে মাছের পরিমাণ কম থাকায় প্রত্যাশিত লাভের মুখ দেখতে পারেননি তাঁরা।

উপজেলার চন্দ্রদ্বীপের জেলে মো. রফিক মাঝি (৪০) বলেন, দিনদিন তেঁতুলিয়া নদী ছোট হয়ে আসছে, ইলিশ মাছের পরিমাণও কমছে। এ বছর মৌসুম জুড়েই ছিল ইলিশের আকাল।

কালাইয়া বগী খালের তুলাতলা এলাকার জেলে মো. শহিদ মোল্লা (৪৫) তেঁতুলিয়া নদী ও সাগরে মাছ ধরেন। তাঁর ট্রলারে আরও চারজন জেলে আছেন। তিনি বলেন, এ বছর তিনি চারবার বঙ্গোপসাগরে গিয়েছেন ইলিশ মাছ ধরার জন্য। প্রতিবার ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। দুইবার খরচের টাকা উঠলেও বাকি দুইবার তাঁর লোকসান হয়েছে। বাকি সময় তেঁতুলিয়া নদীতে জাল ফেলেছেন। তাতেও তেমন ইলিশ মাছ ধরা পড়েনি। তিনি আরও বলেন, এ বছর সাগরে ও নদীতে ইলিশ মাছ ধরার খরচ বাবদ আড়তদারের কাছ থেকে ৪ লাখ দাদন নিয়েছিলেন। ব্যাংকঋণও আছে ৮০ হাজার টাকা, যা মাছ পেয়েছেন তা বিক্রি করে খরচ দিয়ে সমান সমান। ঋণের বোঝা মাথাই রয়েই গেছে। একইভাবে হতাশার কথা জানিয়েছেন জেলে মোকলেছ মাঝি (৫০), সুজন দফাদার (৩২), এছাহাক মাঝি (৪৫) ও কুদ্দুস বয়াতি (৩৮)।

ইলিশ যখন মাইগ্রেট করে সাগর থেকে নদীতে আসে, তখন তার একটি নির্দিষ্ট গভীরতার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সাগর থেকে নদীতে ঢুকতে মোহনায় যখন পর্যাপ্ত গভীরতা পায় না, তখন তারা আবার সাগরে ফিরে যায়। এটা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হচ্ছে ড্রেজিং।
লোকমান আলী, অধ্যাপক, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগ

তেঁতুলিয়া নদীতে কয়েক বছর ধরে ইলিশ মাছ কমতে থাকায় উদ্বেগ জানিয়েছেন জেলে, ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা। জাটকা মৌসুমে নির্বিচারে জাটকা নিধন করায় নদীতে ইলিশ কমছে বলে দাবি করেছেন জেলেরা। তাঁরা জানান, সাগর মোহনা থেকে শুরু করে নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট বাধা জাল দিয়ে ইলিশের ডিম, চাপিলা ও জাটকা মাছ ধ্বংস করা হয়। এ কারণে মৌসুমেও জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়ছে না।

ভরা মৌসুমে নদীতে ইলিশ না পাওয়ার বিষয়ে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. লোকমান আলী বলেন, ‘সাগর মোহনায় ডুবোচরের বিষয় নিয়ে আমরাও ভাবছি। ইলিশ যখন মাইগ্রেট করে সাগর থেকে নদীতে আসে, তখন তার একটি নির্দিষ্ট গভীরতার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সাগর থেকে নদীতে ঢুকতে মোহনায় যখন পর্যাপ্ত গভীরতা পায় না, তখন তারা আবার সাগরে ফিরে যায়। এটা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হচ্ছে ড্রেজিং। তবে আমাদের দেশে সাগর মোহনায় ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা চালু হয়নি। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।’

মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান সফলভাবে সম্পন্ন করতে সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাউফল উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, জেলে, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে একাধিক সচেতনতা সভা করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার সময়ে মাছ শিকারের জন্য কেউ নদীতে নামলে কঠোর হাতে দমন করা হবে। শতভাগ মা ইলিশ রক্ষা করা সম্ভব হলেই ইলিশ বাড়বে বলে মন্তব্য করেন এ কর্মকর্তা।