জালিয়াতি
জালিয়াতি

ফারুকের নামে ব্যাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করছিলেন মিনহাজ, ৫৬ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে উধাও

বাংলাদেশ ব্যাংক সিলেট কার্যালয়ে ২০১১ সালের ১৯ মে থেকে মো. ফারুক মিয়া নামে অস্থায়ী ও দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে ‘হেলপার-টু-প্লাম্বার’ পদে নিয়োগ পান মিনহাজ মিয়া। আর ২০১২ সালের ১২ জুন থেকে নিয়মিত কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ হয় তাঁর। পরবর্তী সময়ে চাকরিবিধি অনুসরণ করে অগ্রিম গৃহনির্মাণের জন্য দুই কিস্তিতে ৫৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ঋণ নেন। ঋণ নেওয়ার পর ২০২৩ সালের ৬ আগস্ট থেকে তিনি আর কর্মস্থলে যাননি। এর পর থেকে তিনি পলাতক।

কর্মস্থলে অনুপস্থিতি, ঋণের কিস্তি ফেরত না দেওয়া ও ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ জমির ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মিনহাজ মিয়ার জাতীয় পরিচয়পত্র, সনদপত্র ও নাম জালিয়াতির বিষয়টি জানতে পারে। এ ঘটনায় গত ২৯ নভেম্বর সিলেট কোতোয়ালি থানায় লিখিত অভিযোগ করেন বাংলাদেশ ব্যাংক সিলেট কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মদ গোলজার হোসেন।

অভিযোগে বলা হয়, ফারুক মিয়া নামে চাকরি করা মিনহাজ মিয়া প্রতারণা এবং বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন। অন্যের পরিচয় ধারণ করে, অন্যের শিক্ষাসনদ ও ঠিকানা জালিয়াতি করে ঋণ হিসেবে নিয়ে টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

মোহাম্মদ গোলজার হোসেন বলেন, তিনি ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী থানায় অভিযোগ করেছেন। যেহেতু বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ায় রয়েছে, তিনি এ ব্যাপারে কথা বলতে চান না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মো. ফারুক মিয়া টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার গান্দিনা গ্রামের মো. আনোয়ার হোসেনের ছেলে এবং মিনহাজ মিয়া টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার ফুলবাড়ি ইউনিয়নের উত্তরপাড়া গ্রামের আবদুল জলিল মিয়ার ছেলে। ফারুক মিয়াকে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে তাঁর শিক্ষাসনদ সংগ্রহ করেছিলেন মিনহাজ মিয়া। এরপর ফারুকের নামে মিনহাজ চাকরি করতে থাকেন। একপর্যায়ে চাকরি না পেয়ে ফারুক মিয়া প্রবাসে চলে যান।

বাংলাদেশ ব্যাংক সিলেট কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মিনহাজ মিয়ার মামা সাইফুল ইসলাম মিয়াও বাংলাদেশ ব্যাংক সিলেট কার্যালয়ে প্রকৌশল শাখায় কর্মরত ছিলেন। সাইফুলই মিনহাজকে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাছে মো. ফারুক মিয়া নামে পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সূত্র ধরেই ফারুক মিয়া নামে মিনহাজ মিয়া চাকরি পান। প্রথমে অস্থায়ীভাবে চাকরি পাওয়ার পর পরবর্তী সময়ে তাঁকে স্থায়ী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। চাকরি স্থায়ী হওয়ার পর বিধি অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ২০২৩ সালে ঋণ নেন তিনি। ব্যাংক থেকে ৫৬ লাখ টাকা ঋণ ছাড়া মিনহাজ ব্যাংকের কর্মচারী সমিতি ও সহকর্মীদের কাছ থেকে আরও প্রায় ৪০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। সে টাকার কিছু অংশ দিয়ে সিলেট শাহপরাণ বাইপাস এলাকায় কিছু জমি নিয়েছিলেন মিনহাজ। সে জমি ফারুক মিয়ার নামে ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ ছিল। ঋণ নেওয়ার পর থেকে তিনি অনিয়মিত কিস্তি দিতেন। ছুটি না নিয়েই মিনহাজ ২০২৩ সালের ৬ আগস্ট থেকে কার্যালয়ে অনুপস্থিত আছেন।

ব্যাংক থেকে ৫৬ লাখ টাকা ঋণ ছাড়া মিনহাজ ব্যাংকের কর্মচারী সমিতি ও সহকর্মীদের কাছ থেকে আরও প্রায় ৪০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন।

ঋণের বিষয়ে যাচাই-বাছাই করার সময় মো. ফারুক মিয়া নামে ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ জমি সাবরেজিস্ট্রি কার্যালয়ে দাখিল করা জাতীয় পরিচয়পত্র ভুয়া হিসেবে শনাক্ত করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক সিলেট কার্যালয়ে কর্মরত মো. ফারুক মিয়ার প্রকৃত নাম মিনহাজ মিয়ার ছবিসহ তথ্য পাওয়া যায়। ভুয়া সনদ ও মো. ফারুক মিয়ার নাম ব্যবহার করে মিনহাজ মিয়া কর্মরত ছিলেন বলেও সত্যতা পাওয়া যায়। জালিয়াতির মাধ্যমে মিনহাজ বাংলাদেশ ব্যাংকের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন।

অভিযুক্ত মিনহাজ মিয়ার মুঠোফোন বন্ধ থাকায় তাঁর বক্তব্য নেওয়া যায়নি। তাঁর মামা সাইফুল ইসলাম মিয়ার মুঠোফোন নম্বরে ফোন করা হলে তিনি গাড়িতে আছেন, কথা শোনা যায় না বলে কেটে দেন। আধা ঘণ্টা পর একাধিকবার ফোন করা হলে তিনি আর ধরেননি। পরে আবার ফোন করা হলে সাইফুল ইসলাম বলেন, তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁর ভাগনের ডাক নাম মিনহাজ জানতেন, তবে ভাগনে বলেছিলেন, শিক্ষাসনদে তাঁর নাম মো. ফারুক মিয়া। তাঁর ভাগনে এখন কোথায় আছেন, তা তিনি জানেন না। তিনি ২০০১ সাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করেন। আর তাঁর ভাগনে নিয়োগ পেয়েছিলেন ২০১১ সালে। ভাগনের জালিয়াতির সঙ্গে তিনি জড়িত নন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, মিনহাজকে ফারুক মিয়া নামেই অফিসে সবাই জানতেন। ঋণ নিয়ে পলাতক না হলে কেউ জানতে পারতেন না, তিনি আসলে মিনহাজ। তবে তিনি জালিয়াতি করে ফারুক মিয়া হিসেবে ব্যাংকের সব সুবিধা-সুবিধা ভোগ করেছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক সিলেটের অতিরিক্ত পরিচালক ও তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা মো. গোলাম মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ফারুক নামে চাকরি নেওয়া মিনহাজের মামা সাইফুল ইসলাম মিয়াকে প্রায় এক সপ্তাহ আগে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। মিনহাজের চাকরি এখনো আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁর চাকরি আছে।

সিলেট কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগটি মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের অভিযান অব্যাহত আছে।