সুখবর

তেঁতুলিয়ার হ্যান্ডবল-কন্যারা 

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার কাজী শাহাবুদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্রীরা খেলাধুলায় তুখোড়। প্রায় প্রতিবছরই তাঁরা জাতীয় পর্যায়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছেন।

তেঁতুলিয়ার কাজী শাহাবুদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের কৃতী খেলোয়াড়েরা
ছবি: প্রথম আলো

কেউ থাকেন ভাঙা ঘরে। কেউ প্রত্যন্ত গ্রামে। কারও বাবা নেই। কারও বাবা শ্রমিক। অভাবের সংসারে দুবেলা খাবার ঠিকমতো জোটে না। এমন দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়েও অনন্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তাঁরা। কঠোর পরিশ্রম ও নিরলস অধ্যবসায়ের বলে তাঁরা এখন দেশ ও দশের গর্ব। বিদেশ থেকেও সুনাম কুড়িয়ে এনেছেন জাতীয় নারী হ্যান্ডবল দলের আট খেলোয়াড়।

তাঁদের সবার বাড়ি দেশের সর্ব উত্তরের উপজেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়। সেখানকার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী তাঁরা। দীক্ষা নিয়েছেন দুই কোচের অধীনে। কোচ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিবিড় তত্ত্বাবধানে বেরিয়ে এসেছে দুর্দান্ত সব খেলোয়াড়। শুধু কি এই আটজন? এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাবেক শিক্ষার্থীদের বিচরণও এখন দেশের ক্রীড়াঙ্গনের নানা শাখায়। হ্যান্ডবল, ভলিবল, কাবাডি, শুটিংয়ে অন্তত ৫০ জন কৃতী খেলোয়াড় তৈরি হয়েছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। তাঁদের কেউ জাতীয় কাবাডি দলের, কেউবা শুটিংয়ের কোচ, কেউ আনসার দলের, কেউবা পুলিশের হ্যান্ডবল দলের অধিনায়ক।

কৃতী এই খেলোয়াড়েরা তেঁতুলিয়ার কাজী শাহাবুদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী। আর তাঁদের দুই কোচ ও শিক্ষকের একজন আবুল হোসেন, অপরজন আবদুস সালাম।

তেঁতুলিয়ার এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও খেলোয়াড়দের সম্পর্কে জানেন পঞ্চগড় নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও আইনজীবী এরশাদ হোসেন সরকার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবুল হোসেনের মতো একজন দক্ষ শিক্ষক, আর মেয়েদের মনোবল ছিল বলেই তেঁতুলিয়ার মেয়েরা আজ ক্রীড়াঙ্গনে বিশেষ অবদান রাখছে। আমরা দেখেছি, খেলাধুলায় কলসিন্দুরের মেয়েরা সুনাম অর্জন করেছে। তেঁতুলিয়ার মেয়েরাও কিন্তু পিছিয়ে নেই। তাদের প্রচারণা হয়তো কম হয়েছে। বড় পরিসরে তাদের সংবর্ধনা দেওয়া উচিত। তারা আরও অনুপ্রাণিত হবে। আরও অনেক কিশোরী, তরুণী খেলাধুলায় এগিয়ে আসবে।’

বাধা ডিঙিয়ে খেলোয়াড়েরা

বাংলাদেশ জাতীয় নারী হ্যান্ডবলের আট সদস্য হলেন সানজিদা আক্তার, মোছা. মারফি, জিমি আক্তার, সাকিবা জান্নাত, শ্যামলী মিনজ, রুবিনা আক্তার, পারুল আক্তার ও আছিয়া খাতুন। তাঁদের মধ্যে শেষের তিনজন কাজী শাহাবুদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের প্রাক্তন ছাত্রী; বাকিরা বিভিন্ন শ্রেণিতে পড়ে।

জাতীয় নারী হ্যান্ডবল দলের অন্যতম সদস্য সানজিদা আক্তার একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। বাবা মো. ওহেদুল ২০০৭ সালে মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর মা বেলী আক্তার কষ্টেসৃষ্টে মেয়েদের বড় করেছেন। চার বোনের মধ্যে সানজিদা তৃতীয়। পড়াশোনার পাশাপাশি হ্যান্ডবলে তুখোড় সে।

নারী হ্যান্ডবল দলের খেলোয়াড় মোছা. মারফি নবম শ্রেণির ছাত্রী। তার বাবা মো. মালেক মহানন্দা নদীতে পাথর তুলে সংসার চালান। তিন ভাইবোন, মা–বাবা, দাদিসহ ছয়জনের সংসার মারফিদের। অভাব–অনটনের সংসার থেকে উঠে আসা মারফি জাতীয় নারী হ্যান্ডবল দলের কনিষ্ঠতম খেলোয়াড়।

জাতীয় নারী হ্যান্ডবল দলের আরেক সদস্য জিমি আক্তার একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। সে পাথরশ্রমিক আবদুল জলিলের মেয়ে। এ ছাড়া শ্যামলী মিনজ চা–শ্রমিক সিমন মিনজের মেয়ে। শুধু অভাব ও দারিদ্র্য নয়, কৃতী এই খেলোয়াড়দের নানা সামাজিক বাধা ডিঙিয়ে এ অবধি আসতে হয়েছে। 

জিমি আক্তার বলে, ‘পরিবারে অভাব-অনটন থাকলেও আমরা ভালো খেলার চেষ্টা করি। কিন্তু আমাদের এখানে ভালো মাঠ না থাকায় অনুশীলনে অনেক সমস্যা হয়। আমাদের এখানে একটি ইনডোর স্টেডিয়াম থাকলে খেলোয়াড়দের জন্য সুবিধা হতো।’ অনুশীলনের জন্য বড় মাঠ না থাকার কষ্টের কথা অন্য খেলোয়াড়েরাও জানালেন।

পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘তেঁতুলিয়ার মেয়েদের অনুশীলনের জন্য একটি ইনডোর স্টেডিয়াম করতে ইতিমধ্যে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। আশা করছি, দ্রুত তেঁতুলিয়ায় একটি স্টেডিয়াম হবে।’

দুই কোচের কথা

কাজী শাহাবুদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজটি ১৯৮৩ সালে তেঁতুলিয়া উপজেলা শহরের কাজীপাড়া এলাকায় ১ একর ৬৪ শতক জমির ওপর স্থাপিত হয়। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েরা পড়ে এখানে। এই প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে স্কুল ও কলেজ শাখা মিলে ১ হাজার ১৭৩ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।

খেলোয়াড় তৈরির প্রধান কোচ ছিলেন শরীরচর্চার শিক্ষক আবুল হোসেন। একদম শুরু থেকেই শরীরচর্চার শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। ২০১৬ সালে অবসরে যাওয়ার পরও দীর্ঘদিন মেয়েদের অনুশীলনে সহায়তা করেছেন। ২০১৮ সালে শরীরচর্চা শিক্ষক পদে যোগ দেন আবদুস সালাম। আবুল হোসেনের পথ ধরে তিনিও খেলোয়াড় তৈরিতে মগ্ন হয়ে পড়েন। এরই ধারাবাহিকতায় তেঁতুলিয়ার মেয়েরা তাঁদের সাফল্য ধরে রেখেছেন।

আবদুস সালাম বলেন, তেঁতুলিয়ার মেয়েরা দেশ-বিদেশের ক্রীড়াঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। তাঁদের তৈরি করতে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। অনেক সময় ছাত্রীরা না খেয়ে আসে। রিকশাভ্যানে করে অনুশীলনে আসার ভাড়া পর্যন্ত থাকে না। মেয়েদের আগ্রহ আর পরিবারের সমর্থন থাকায় তাঁদের গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠান প্রধানেরও আন্তরিকতা আছে।

সম্প্রতি এক বিকেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে গিয়ে দেখা যায়, মাঠে জায়গা না থাকায় পাশের একটি খোলা মাঠে মেয়েদের হ্যান্ডবল অনুশীলন করাচ্ছেন শিক্ষক আবদুস সালাম। খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে নয়টা পর্যন্ত এবং বিকেল চারটা থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত দুবার অনুশীলন করেন তাঁরা।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ ইমদাদুল হক বলেন, ‘নানা বাধা উপেক্ষা করে আমাদের মেয়েরা সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। তাদের গড়ে তুলতে আমরা স্থানীয় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সহযোগিতা পেয়েছি।’

তাঁদের যত অর্জন

চলতি বছর ৪৯তম জাতীয় স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় হ্যান্ডবলে (বালিকা) জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রীদের দল। জাতীয় পর্যায়ে হ্যান্ডবলে (বালিকা) ১৯৯৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আটবার চ্যাম্পিয়ন ও চারবার রানার্সআপ হয়েছিল তারা। ভলিবলেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রীরা। জাতীয় স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা শীতকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ভলিবলে দুবার চ্যাম্পিয়ন ও দুবার রানারআপ হয়েছে তারা।

২০২১ সালে ওয়ালটন অনূর্ধ্ব–১৬ হ্যান্ডবল প্রতিযোগিতায় কাজী শাহাবুদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের মেয়েরা জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। চলতি বছরের আগস্টে তুরস্কের কোনিয়ায় অনুষ্ঠিত পঞ্চম ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে বাংলাদেশ নারী হ্যান্ডবল দলের যে ১৬ জন খেলোয়াড় অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের আটজনই ছিলেন কাজী শাহাবুদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী।

এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ছাত্রীরাও দেশের ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছেন। বড় বোনদের দেখানো পথ ধরে বহুদূর যাওয়ার স্বপ্ন দেখে এখনকার কৃতী খেলোয়াড়েরা।