নদে ময়লা-আবর্জনাও ফেলা হচ্ছে। এতে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দখল ও দূষণে নদটি এখন অস্তিত্বসংকটে।
জামালপুরের ঝিনাই নদের কোথাও ভরাট করা হয়েছে, কোথাও নদের পাড়ে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। কোথাও আবার নদ থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। অন্যদিকে নদে ময়লা-আবর্জনাও ফেলা হচ্ছে। এতে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দখল ও দূষণে নদটি এখন অস্তিত্বসংকটে।
গত বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, কোথাও বেড়া দিয়ে, কোথাও মাটির বাঁধ দিয়ে নদের জায়গা দখল করা হয়েছে। পানি আটকে অনেকেই মাছ ধরছেন। জামালপুর-মেলান্দহ মহাসড়কের ঝিনাই সেতুর দুই পাশ দখল হয়ে গেছে। সেতুর উত্তর পাশে বালু তুলে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। কম্পপুর মোড়ে নদের উত্তর পাড় কিছু মানুষ ভরাট করে জায়গা বাড়িয়ে দোকান নির্মাণ করেছেন। এর একটু সামনেই নদে বর্জ্যের স্তূপ। বাসাবাড়ির আবর্জনা নদে ভাসছে। সেখানে দুর্গন্ধে দাঁড়িয়ে থাকা দায়।
চন্দ্রা এলাকায় নদের পাড় কেটে বালু বিক্রি করা হচ্ছে। হাট চন্দ্রা পশ্চিমপাড়ায় নদে খননযন্ত্র বসানো। নদের পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বহু কাঁচা, আধা পাকা ও পাকা স্থাপনা। যত দূর চোখ যায় কালো পানি।
নদপাড়ের চন্দ্রার বাসিন্দা মো. ইকবাল হোসেন বলেন, দুই থেকে তিন যুগ আগেও এই নদে বড় বড় নৌকা চলাচল করত। নৌকা দিয়ে সরিষাবাড়ী উপজেলার জগন্নাথগঞ্জ ঘাটেও যাওয়া যেত। এখন এক কিলোমিটারও যেতে পারবেন না। কোথাও বাঁধ দেওয়া হয়েছে, কোথাও বেড়া দেওয়া হয়েছে, কোথাও দখল হয়েছে। এভাবেই নদটি এখন মরে গেছে। আগে গভীর পানি ছিল। এখন শুষ্ক মৌসুমে পানিই থাকে না।
কম্পপুর এলাকার আবদুল হালিমের বাড়ি নদের তীরে। তিনি বলেন, ‘বাপুরে, আগে কত নদের ধার (স্রোত) ছিল। ঘর থেকে নদের ডাক শোনা যেত। কত নৌকা চলত। এই নদে মাছ ধরেই অনেকের সংসার চলত। এখন সেই দিন নাই। নদের সর্বনাশ অনেক আগেই হয়ে গেছে।’
প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, ঝিনাই নদটি ১৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ। পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে ঝিনাই নদের উৎপত্তি। জামালপুর শহরের পশ্চিম পাশ দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে। আগে ঝিনাই নদের সঙ্গে টাঙ্গাইলের বংশী নদীর সরাসরি সংযোগ ছিল। বর্তমানে নদীটির বেশির ভাগই ভরাট ও দখলে পানিপ্রবাহ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। কৃষকেরা জমিতে সেচ দিতে পারছেন না। দখলে প্রতিনিয়ত আয়তন সংকুচিত হচ্ছে। যেসব জায়গায় পানি রয়েছে, সেখানে পানি কুচকুচে কালো। একসময়ের খরস্রোতা নদীটি এখন এক মরা খাল।
জামালপুরের নদী রক্ষা কমিশনের সদস্য জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, ঝিনাই নদ ৪০-৫০ শতাংশ শহরের মধ্য দিয়ে গেছে। নদটি অনেক আগেই নাব্যতা হারিয়েছে। বর্তমানে অবস্থা খুব নাজুক। বহুদিন ধরে নদের পাড়ে দখলদারদের দৌরাত্ম্য চলছে। সেই সঙ্গে নদের আশপাশের লোকজন নদের জমি দখল করে যাচ্ছেন। সেই সঙ্গে ময়লা-আবর্জনা ফেলে পানিদূষণ চলছে। যে যেভাবে পারছেন নদটিকে দখল করছেন, দূষিত করছেন। অনেক আগেই পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তাঁদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে নদটি রক্ষার জন্য আন্দোলন করেছেন। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি।
পরিবেশবিদেরা বলছেন, নদটিকে বাঁচাতে অন্তত ৫০ ফুট পরপর নদের সীমানা নির্ধারণী খুঁটি স্থাপন করতে হবে। দখলদারদের তালিকা তৈরি ও উচ্ছেদ করতে হবে। নদে আবর্জনা ফেলা যাবে না, নদ পরিষ্কার করতে হবে। দূষণের উৎসমুখ চিহ্নিত করতে হবে। বিভিন্ন স্থানে পানিপ্রবাহ আটকে দেওয়া বাঁধগুলো খুলে দিতে হবে। পানির প্রবাহ স্বাভাবিক না করতে পারলে নদ আগের অবস্থায় ফিরবে না।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লিটুস লরেন্স চিরান বলেন, অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ওই নদের বিভিন্ন অংশ ভরাট করে দখল করা হচ্ছে। অনেক জায়গায় অবৈধভাবে বালুও উত্তোলন করা হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। দখলদারদের চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ওই নদ খননের মাধ্যমে পানিপ্রবাহ সচল করতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) একটি জরিপ করেছে। যদি বিআইডব্লিউটিএ কোনো প্রকল্প হাতে না নেয়, সে ক্ষেত্রে পাউবো নতুন প্রকল্প নেওয়ার ব্যবস্থা করবে। দখল ও দূষণের বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।