কুমিল্লার ১২০ কিলোমিটার রেলপথে গত পাঁচ বছরে শুধু অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে ১৮টি দুর্ঘটনায় অন্তত ৩০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। জেলার মধ্য দিয়ে যাওয়া ঢাকা-চট্টগ্রাম, লাকসাম-নোয়াখালী ও লাকসাম-চাঁদপুর—তিনটি রেলপথের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ীসহ নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ। অবৈধ রেলক্রসিংয়ের বাইরে রেলপথে ট্রেনে কাটা পড়ে, বৈধ রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় আরও অনেকে মারা গেছেন।
স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, বছরের পর বছর ধরে দাবি জানিয়ে এলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গেট নির্মাণ করা হয় না। এ জন্য অবৈধ রেলক্রসিংয়ে চলাচলের সময় ট্রেন দুর্ঘটনা বাড়ছে।
তবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, স্বল্প জনবল নিয়ে ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথে নজরদারি করা কঠিন। অবৈধ রেলক্রসিং দিয়ে চলাচলের ব্যাপারে তারা এলাকাবাসীকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেয়। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে রেলগেট নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে তারা কাজ করছে বলে জানায়।
রেলওয়ে ও স্থানীয় সূত্রে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কুমিল্লায় পাঁচ বছরে অবৈধ রেলক্রসিংয়ে ১৮টি দুর্ঘটনার মধ্যে ৪টি বাদে সবগুলো দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে। তবে লাকসাম-চাঁদপুর রেলপথে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। এর মধ্যে চলতি বছর ৬টি দুর্ঘটনায় অবৈধ রেলক্রসিংয়ে ১১ জন মারা গেছেন। এ ছাড়া ২০২০ সালে দুজন, ২০২১ সালে পাঁচজন, ২০২২ সালে ছয়জন ও ২০২৩ সালে পাঁচজনের মৃত্যু হয়। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে দুজন শিক্ষার্থী, দুজন শিক্ষক, একজন করে ব্যবসায়ী ও এনজিও কর্মকর্তা, চারজন অটোরিকশার চালকসহ বাকিরা যাত্রী ও পথচারী।
কুমিল্লার আট উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬ বার দুর্ঘটনা ঘটেছে নাঙ্গলকোটে, মারা গেছেন ১০ জন। এ ছাড়া লাকসাম ও সদর দক্ষিণে তিনটি করে, লালমাইয়ে দুটি, ব্রাহ্মণপাড়া, মনোহরগঞ্জ, আদর্শ সদর ও বুড়িচংয়ে একটি করে দুর্ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার বুড়িচংয়ের কালিকাপুর এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের একটি অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালক, যাত্রীসহ সাতজন নিহত হন।
সর্বশেষ বুড়িচংয়ের দুর্ঘটনার আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে মোট ১৩টি দুর্ঘটনা ঘটে। চলতি বছরের ৪ নভেম্বর লালমাই উপজেলার হরিশ্চর এলাকায় এক নারী, ২৪ জুন সদর দক্ষিণ উপজেলার শিকারপুর এলাকায় এক ব্যক্তি, ৮ জুন নাঙ্গলকোট সদরের বিশারা এলাকায় এক বৃদ্ধ, ১৬ মে আদর্শ সদর উপজেলার রসুলপুরে এক ছাত্রী, ২৫ জানুয়ারি নাঙ্গলকোট পৌর বাজারের পাশে এক এনজিও কর্মকর্তা মারা যান।
২০২৩ সালের ২২ অক্টোবর ব্রাহ্মণপাড়ার শশীদল সেনের বাজার এলাকায় এক অটোরিকশাচালক, ৩ জুন সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুরসংলগ্ন জেলখানাবাড়িতে অটোরিকশাচালক বাবা ও ছেলে এবং একই বছরের ১৯ মে লাকসাম পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়সংলগ্ন এলাকায় এক স্কুলশিক্ষক নিহত হন। ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি লাকসাম পৌরসভার এতিমখানা সড়কে অবৈধ ক্রসিংয়ে এক যুবক এবং একই বছরের ২৯ জানুয়ারি নাঙ্গলকোটের বান্নঘর এলাকায় এক ফল ব্যবসায়ী মারা যান।
২০২১ সালের ১২ জানুয়ারি বান্নঘর এলাকায় বাবা-ছেলে, ১০ ফেব্রুয়ারি একই স্থানে এক বৃদ্ধা, ২৫ জানুয়ারি নাঙ্গলকোট পৌর বাজারের পাশে এক এনজিও কর্মকর্তা এবং ২৯ আগস্ট লালমাইয়ের হরিশ্চর এলাকায় অরক্ষিত ক্রসিংয়ে মোটরসাইকেল আরোহী দুই বন্ধু নিহত হন।
বান্নঘর এলাকার সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ওই ক্রসিংটি বৈধ করার দাবি জানিয়ে আসছেন এলাকাবাসী। কিন্তু আজও দাবি পূরণ হয়নি। অরক্ষিত ক্রসিংটি মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। গত তিন বছরে সেখানে অন্তত চারজনের মৃত্যু হয়েছে।
কুমিল্লার তিনটি রেলপথের মধ্যে লাকসাম-চাঁদপুর রেলপথে গত পাঁচ বছরে অবৈধ ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে লাকসাম-নোয়াখালী রেলপথে চারটি দুর্ঘটনায় সাতজনের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে ২০২৩ সালের ১৯ মে লাকসাম পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয় লাগোয়া অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে এক স্কুলশিক্ষক ও একই বছরের ২ অক্টোবর লাকসামের পৌর এলাকায় আরেক শিক্ষকের মৃত্যু হয়। ২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর ওই রেলপথে মনোহরগঞ্জের নাথেরপেটুয়া এলাকায় অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে আবু ইউসুফ নামের এক কলেজছাত্র মারা যান।
এ ছাড়া ২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর নাঙ্গলকোটের তুঘুরিয়া এলাকায় অবৈধ রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকসহ চারজন নিহত হয়েছিলেন। তাঁদের বাড়ি পাশের মনোহরগঞ্জ উপজেলার উত্তর হাওলা গ্রামে।
ওই গ্রামের বাসিন্দা আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, চারজনের প্রাণহানির ঘটনার পর ওই জায়গায় রেলগেট নির্মাণ ও গেটম্যান নিয়োগের দাবিতে একাধিকবার মানববন্ধন হয়েছিল। কিন্তু আজও সেই দাবি পূরণ হয়নি। এখনো ঝুঁকি নিয়ে মানুষ চলাচল করছে।
অবৈধ রেলক্রসিংয়ের বাইরে বৈধ ক্রসিং ও রেলপথে ট্রেন দুর্ঘটনায় অনেকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। ২০২৩ সালের ২৬ জুলাই সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর রেলক্রসিং এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় এক নারী ও এক শিশু নিহত হয়েছে। বিরতিহীন সোনার বাংলা এক্সপ্রেস তাদের ধাক্কা দেয়।
২০২২ সালের ৯ মার্চ একই রেলক্রসিং এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিন শিশুশিক্ষার্থী নিহত হয়। চলতি বছরের ১৩ অক্টোবর আদর্শ সদরের শাসনগাছা রেলক্রসিংয়ে রেলপথ পার হওয়ার সময় ট্রেনে কাটা পড়ে আপন রবি দাস (৪০) নামের এক যুবক নিহত হন।
জানতে চাইলে লাকসাম রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. এমরান হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় ১২০ কিলোমিটার রেলপথে সব জায়গায় তদারক করা কঠিন। যেসব স্থানে রেলগেট নেই, সেখানে মানুষকে সচেতন হয়ে চলাচল করতে হবে। বিশেষ করে রেলপথ পারাপারের সময় যান চালকদের সতর্ক থাকতে হবে। তাহলে দুর্ঘটনা কমে আসবে। বিগত সময়ে রেলওয়ে পুলিশ যতগুলো মৃত্যুর ঘটনার খবর পেয়েছে, সবগুলোতেই রেলওয়ে থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।
পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) এ বি এম কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কুমিল্লায় রেলপথে থাকা অরক্ষিত ক্রসিংগুলোর ব্যাপারে তাঁরা অবগত আছেন। কয়েকটি স্থানে রেলগেট নির্মাণসহ লোকবল নিয়োগ করা প্রয়োজন। গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রেলগেট নির্মাণের পরিকল্পনা তাঁদের আছে। তাঁরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন।