ঠাকুরগাঁও সদরের সালন্দর এলাকার একটি চায়ের দোকানে গল্প করছিলেন আওয়ামী লীগের ১০-১২ জন কর্মী। আলাপের বিষয়বস্তু উপজেলা নির্বাচন। কার পক্ষে ভোট করবেন, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা। কথার ফাঁকে বললেন, গতবার সবাই নৌকার নির্বাচন করেছেন। এবার আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা প্রার্থী হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তাঁরা। এমতাবস্থায় দলে বিভাজন তৈরি হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনে আগামীকাল ২১ মে সদর উপজেলা পরিষদের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এখানে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান চেয়ারম্যান অরুণাংশু দত্ত (আনারস), সাধারণ সম্পাদক মোশারুল ইসলাম সরকার (মোটরসাইকেল), সহসভাপতি রওশনুল হক (ঘোড়া) ও আওয়ামী লীগের নেতা কামরুল হাসান (কাপ পিরিচ)। মূলত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে পুরো উপজেলা। ভোট নিয়ে ভোটারদের তেমন কোনো মাতামাতি নেই। প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকেরা শক্তি প্রদর্শনে প্রতিদিন মোটরসাইকেল মহড়া ও মিছিল করছেন। এখন পর্যন্ত সহিংসতা না হলেও উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই শীর্ষ নেতার বাগ্যুদ্ধের কারণে যেকোনো সময় পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।
এবার দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করছে না আওয়ামী লীগ। প্রার্থিতা উন্মুক্ত থাকায় দলটির একাধিক নেতা প্রার্থী হয়েছেন। তবে কোথাও কোথাও সংসদ সদস্যরা পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে সমর্থন দিচ্ছেন। ঠাকুরগাঁও-১ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেনের বিরুদ্ধে একজনের পক্ষ নিয়ে নির্বাচনে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ উঠেছে। অনুগত প্রার্থী মোশারুল ইসলামকে জেতাতে দলীয় নেতা-কর্মীসহ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নির্দেশনা দিয়েছেন।
সম্প্রতি দলের এক সভায় রুহিয়া পশ্চিম ইউপির চেয়ারম্যান অনিল সেন বলেন, ‘আমাদের সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন বলেছেন মোটরসাইকেলের পক্ষে ভোট করার জন্য। এখানে চারজন প্রার্থী আছেন। চারজনই আওয়ামী লীগের। কিন্তু আমরা আমাদের নেতার যে পরামর্শ পাব, সেটাই করব। তার বাইরে কখনো যাব না।’
রুহিয়া থানা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক গণেশ চন্দ্র সেনও একই ধরনের ঘোষণা দিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করে এক ইউপির চেয়ারম্যান বলেন, ‘সংসদ সদস্য আমাদের অভিভাবক। তিনি পরামর্শ দিলে না মানলে বেয়াদবি হয়। তাঁর সম্মানে আমরা মোটরসাইকেলে চড়ে বসেছি।’
নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরুর পর আওয়ামী লীগ ও সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের অনেক নেতাকে আনারস প্রতীকের পক্ষে দেখা গেলেও সংসদ সদস্যের নির্দেশনার পর তাঁরা দল বেঁধে মোটরসাইকেলের পক্ষে মাঠে নামেন। কেউ কেউ অবশ্য আনারস প্রতীকের পক্ষে থেকে গেছেন।
১৪ থেকে ১৮ মে মোটরসাইকেল ও আনারস প্রতীকের কয়েকটি পথসভা ও বৈঠকে দেখা গেছে, মোটরসাইকেল প্রতীকের সভায় দলের শীর্ষ নেতারা অংশ নিচ্ছেন। তবে কর্মীর সংখ্যা কম। অন্যদিকে আনারস প্রতীকের সভায় হাতেগোনা দু-একজন নেতা থাকলেও কর্মীর সংখ্যাই বেশি।
জেলা আওয়ামী লীগের দু-একজন নেতা ছাড়া বাকিরা সবাই মোটরসাইকেলের পক্ষে কাজ করছেন। প্রায় প্রতিটি ইউনিটের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের কেউ আনারস, আবার কেউ মোটরসাইকেলের পক্ষে কাজ করছেন। বিভাজন শুধু জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নয়; ইউনিয়ন এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়েও দেখা গেছে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মনিরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলা নির্বাচন ঘিরে দলে দ্বন্দ্বের বীজ বপন হয়ে গেল। এরপর বীজ থেকে চারা হবে। সেই চারা একসময় বিশাল বৃক্ষে রূপ নেবে।
তবে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দীপক কুমার রায় বলেন, নির্বাচন উন্মুক্ত করে দেওয়ায় নেতা-কর্মীরা যাঁর যাঁকে ভালো লাগছে, তাঁর হয়ে কাজ করছেন। নির্বাচন ঘিরে যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে, তা কেটে যাবে। স্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা নেই।
রমেশ চন্দ্র সেন ঠাকুরগাঁও-১ আসনের পাঁচবারের সংসদ সদস্য। এলাকাবাসী ও নেতা-কর্মীদের অনেকেই মনে করেন, এবার মেয়াদকাল পূর্ণের পর তিনি আর নির্বাচন করবেন না। তাঁর স্থলে তিনি ভাতিজা ও রুহিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি পার্থ সারথি সেনকে বসাতে চান। চেয়ারম্যান প্রার্থী অরুণাংশু দত্ত ভবিষ্যতে সংসদ সদস্য নির্বাচন করবেন। এ জন্য তাঁকে রুখতে সংসদ সদস্য তাঁর বিপক্ষে নেতা-কর্মীদের মাঠে নামিয়েছেন।
ঠাকুরগাঁও পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, ‘কাকার (রমেশ) অনেক বয়স হয়েছে। শেষ বয়সে নিজের চেয়ারে ভাতিজাকে বসাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তিনি ভালো করেই জানেন, অরুণাংশু দত্ত থাকলে পার্থ সারথি সুবিধা করতে পারবেন না। তাই অরুণাংশুকে হারিয়ে রাস্তা ফাঁকা করার ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন। কিন্তু আমরা এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে দেব না।’
অরুণাংশু দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে হারাতে শীর্ষ পর্যায় থেকে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আমার নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করেছেন, কাকা তাঁদের মোটরসাইকেলের ভোট করতে চাপ দিচ্ছেন। ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। তবে যতই ষড়যন্ত্র করুন, শেষ পর্যন্ত সফল হবে না। তৃণমূলের কর্মীরা এই ষড়যন্ত্রের জবাব দেবেন।’
সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলা নির্বাচনে সবাই আওয়ামী লীগেরই প্রার্থী। এখানে কারও পক্ষ নেওয়ার সুযোগ নেই। নিজের উত্তরসূরির বিষয়ে বলেন, ‘গায়ের জোরে নেতৃত্ব পাওয়া যায় না। যোগ্যতা থাকলে নেতৃত্ব এমনিতেই ধরা দেবে। এসব বলে শৃঙ্খলা নষ্ট করার সুযোগ নেই।’
উপজেলা নির্বাচন ঘিরে দলের বিভাজন বহুদূর গড়াবে বলে মন্তব্য করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক ইন্দ্রনাথ রায়। তিনি বলেন, বিভাজন থেকে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে পারে। সেই দ্বন্দ্ব কোথায় নিয়ে যায়, সেটাই দেখার বিষয়।