ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায় মধ্য চরআইচা কোইড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের টিনের ঘর হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে। গতকাল রোববার সকালের দিকে বিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থী দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা দিতে এসে দেখে, তাদের স্কুলঘর নেই। নেই বিদ্যালয়ের আসবাব-কাগজপত্র। সেখানে কয়েকটি সুপারিগাছ লাগানো।
এ ঘটনার প্রতিবাদে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা তাৎক্ষণিক বিদ্যালয়ের সামনের সড়কে মানববন্ধন করেন। তাঁরা যথাস্থানে স্কুলঘর বহাল ও প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানান। তাঁদের অভিযোগ, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি বশির উল্লাহ মিয়া ও তাঁর ছেলে এমদাদুল হকের নেতৃত্বে রাতের আঁধারে স্কুলঘর ভেঙে অন্য কোথাও সরিয়ে নিয়ে গেছেন। তিনি পুরোনো বিদ্যালয়টি সরিয়ে নতুন একটি স্কুল বানিয়ে বাণিজ্যের পাঁয়তারা করছেন।
বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থী বলে, ২১ আগস্ট থেকে তাদের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পাঁচটি পরীক্ষা শেষ হয়। ষষ্ঠ পরীক্ষা দেওয়ার জন্য রোববার এসে দেখে স্কুলঘর নেই। শিক্ষকেরা পরবর্তী সময়ে তাদের বাড়ি বসে পড়তে বলেছে। তারা দ্রুত বিদ্যালয় যথাস্থানে ফেরত দাবি করে।
স্থানীয় ও স্কুল সূত্র জানায়, চরফ্যাশন উপজেলার দক্ষিণ আইচা থানার চরমানিকা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্য আইচা গ্রামে ১৯৯২ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক কো-অপারেশন ইন ডেভেলপমেন্টের (কোইড) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক প্রেইড হাইড। উপজেলার যেসব দুর্গম এলাকায় কোনো বিদ্যালয় ছিল না, কোইড সেখানে ৫৭টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। সব কটিই চলমান। শুধু মধ্য আইচার বিদ্যালয়টি নিয়ে সমস্যা হচ্ছে।
স্কুলঘর উধাও হওয়ার ঘটনায় গতকাল কোইডের অডিটর (বিদ্যালয় পরিদর্শক) এম এন আলমগীর বাদী হয়ে চারজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা তিনজনকে আসামি করে দক্ষিণ আইচা থানায় একটি মামলা করেছেন। মামলার ১ নম্বর আসামি মো. বশির উল্লাহ মিয়া।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে মধ্য চর আইচা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি মো. বশির উল্লাহ মিয়া মুঠোফোনে বলেন, কে বা কারা স্কুলঘর ভেঙে তুলে নিয়ে গেছে, তিনি কিছুই জানেন না। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাঁরা আদালতে গিয়ে জামিন চাইবেন। এমন মামলা হয়ই বলে ফোন কেটে দেন তিনি।
মামলার এজাহার ও কোইডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরে ১১ বছর (১৯৯২-২০০৩ সাল) পর্যন্ত ভালোই চলে আসছিল। পরে জমির মালিক বাধা হয়ে উঠলে এর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন বিদ্যালয়ের শূন্যতা অনুভব করে কোইডের কাছে নতুন করে আরেকটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য আবেদন করেন। তারা বিদ্যালয়ের নামে জমি লিখে দিতেও রাজি হয়।
ওই সময় মধ্য চর আইচার বাসিন্দা মো. বশির উল্লাহ মিয়া ও তাঁর মা ফাতেমা খাতুন ২৪ শতাংশ করে ৪৮ শতাংশ জমি বিদ্যালয়ের নামে লিখে দেন। ২০০৬ সালে পুনরায় বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। সেই থেকে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোইড ৪৮ শতাংশ জমির খাজনা পরিশোধ করে এলেও ফাতেমা খাতুনের ২৪ শতাংশ জমিই ভোগদখল করে আসছে। বাকি ২৪ শতাংশ জমি দাতাসদস্য বিদ্যালয় ব্যবস্থা কমিটির সভাপতি বশির উল্লাহর কাছেই রয়ে যায়। তিনি কখনো জমি বুঝিয়ে দেননি।
২০১৩ সালে সরকার বেসরকারি বিদ্যালয় সরকারীকরণ চালু করলে সভাপতি বশির উল্লাহ কাগজে-কলমে ‘পূর্ব চর আইচা আদর্শ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে নিজের ছেলেকে প্রধান শিক্ষক বানান। গত জানুয়ারি মাসে তিনি ছাত্রছাত্রী ভর্তি শুরু করেন। এর পর থেকে কোইডের বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে টিনের ঘর ছেড়ে চলে যেতে বলেন। বিগত ঘটনার জের ধরে গত শুক্রবার ভোররাতে আসামিরা কোইডের স্কুলঘর, আসবাব ভেঙে অন্যত্র নিয়ে যান বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।
দক্ষিণ আইচা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, মধ্য চর আইচা কোইড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের টিনের ঘরটি তুলে নিয়ে সেখানে দুর্বৃত্তরা সুপারিগাছ লাগিয়ে দিয়েছে। তারপরও সেখানে ঘরভিটার চিহ্ন রয়েছে। মামলার তদন্ত চলছে। কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি।
মধ্য চর আইচার বাসিন্দা শিক্ষক মো. সামসুদ্দিন খোকন বলেন, যখন এ এলাকায় কোনো বিদ্যালয় ছিল না, রাস্তাঘাট ছিল না, তখন কোইড বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করে। এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান খুবই ভালো। প্রতিবছর সমাপনী পরীক্ষায় ৯০-১০০ শতাংশ নম্বর পেয়ে সবাই পাস করে।
চরফ্যাশন উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নওরীন হক বলেন, তদন্ত করে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।