আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলায় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ প্রতিবছর নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তবে এবার তেমন কিছুই হয়নি। এবার দিনটি আসার আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন জেলায় সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডাসহ নানা সম্প্রদায়ের মানুষকে মারধর, বাড়িঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। গ্রামগুলোতে ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছে। কেউ কেউ বাড়িঘর ছেড়ে প্রাণভয়ে লুকিয়ে আছেন।
সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বৃহত্তম সংগঠন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নরেন পাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস হিসেবে বিশ্বের নানা দেশে (৯০টি) পালিত হয়। আদিবাসী হিসেবে তো আমাদের কোনো স্বীকৃতি নেই দেশে। দেশে স্বীকৃতি নেই তো কী হয়েছে? আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসটি কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু এবার আর দিনটি উদ্যাপন করতে পারিনিা। প্রাণের ভয়ে লুকিয়ে আছি পরিবার–পরিজন নিয়ে। নির্ঘুম রাত কাটছে গত কয়েকদিন থেকে। শুধু আমার নয়, এমন নির্ঘুম রাত কাটছে আদিবাসীদের গ্রামে গ্রামে। দুর্বৃত্তদের হামলার ভয়ে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন স্থানে আদিবাসীদের বাড়িঘরে হামলা হয়েছে। হয়েছে লুটপাট ভাঙচুর। মনে হচ্ছে, দেশটা আমার নয়।’
বুধবার রাতে মুঠোফোনে কথা হয় নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার বাসিন্দা নরেন পাহানের সঙ্গে। তিনি আরও বলেন, এই চরম সংকটের সময় নেতা হিসেবে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের পাশে থাকার কথা। তাঁদের সাহস জোগানোর কথা। অথচ হত্যার হুমকির ভয়ে তাঁকে লুকিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এ সময় গলা ধরে আসে তাঁর।
এ ছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলা থেকে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ বর্তমান পরিস্থিতিতে ভয়ভীতির মধ্যে রাত জেগে সময় কাটানোর কথা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।
উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও উচ্চ আদালতের আইনজীবী প্রভাত টুডু বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন জেলায় আদিবাসীদের ওপর হামলা, বাড়িঘরে আগুন লুটপাট হয়েছে। এর মধ্যে নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার আগ্রাদ্বিগুন গ্রামের তারামনি ওঁরাওয়ের বাড়ি ও দোকান লুটপাট করা হয়েছে। ভাদ্রগ্রামের সুধীর তিরকির বাড়ি ও দোকান লুটপাট করা হয়েছে। মহাদেবপুর উপজেলার অলক ওঁরাওকে হত্যাচেষ্টায় মারধর করা হয়েছে। রাজশাহীর গোদাগাড়ীর দেওপাড়া ইউপির যুগিডাইং গ্রামের ৮-১০টি ওঁরাও পরিবারের বাড়িঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে। পাকড়ি ইউপির দেওয়ানপাড়ার গণেশ কিসকুর বাড়িতে হামলা চালিয়ে নগদ টাকাসহ কয়েক লাখ টাকার মালামাল লুটপাট করেছে।
প্রভাত টুডু বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার ঝিলিম ইউপির টংপাড়ার রাজোয়ার আদিবাসীদের দখলে থাকা খাসপুকুর থেকে প্রায় ৫০ মণ মাছ লুট হয়ে গেছে। গোমস্তাপুর উপজেলার পার্বতীপুর ইউপির ইকরাপাড়ায় কয়েকটি বাড়িতে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। নাচোলের বরেন্দা গ্রামের পাশে দেবোত্তর সম্পত্তির ওপর ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও অনেক স্থানে হামলা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে উত্তরাঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের মধ্যে ভয়ভীতি ও আতঙ্ক বিরাজ করছে।
প্রভাত আরও টুডু বলেন, ‘যখনই কোনো সরকার পরিবর্তন হচ্ছে, তখনই আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা তার বলি হচ্ছে। আমরা মনে করি, ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী এই আন্দোলন খুবই যৌক্তিক। কেননা আমরাও বৈষম্যের শিকার। ভেবেছিলাম আন্দোলনের এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে সব ধরনের নিপীড়ন ও বৈষম্য দূর হবে। একটি নতুন ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি হবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা দারুণভাবে হতাশ। হামলা ও লুটপাট চলতে থাকলে ছাত্রজনতার এই গৌরবময় আন্দোলন কালিমালিপ্ত হবে। দ্রুত এর অবসান হওয়া দরকার।’