অভয়নগরে নিলামের আগে গাছ কাটা শুরু

যশোরের অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামে নওয়াপাড়া-মনিরামপুর সড়কের পাশে সামাজিক বনায়নের গাছ কাটা হচ্ছে।রোববার সকালে
ছবি: প্রথম আলো

যশোরের অভয়নগর উপজেলায় নিলামের মাধ্যমে বিক্রির জন্য তিনটি সরকারি রেইনট্রিগাছের মূল্য ‍নির্ধারণ করতে সামাজিক বন বাগান কেন্দ্রকে চিঠি দিয়েছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। সে অনুযায়ী সামাজিক বন বাগান কেন্দ্রের ফরেস্টার গাছ তিনটির সরকারি মূল্য নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দেন। পরে এ ব্যাপারে আর কোনো সিদ্ধান্ত নেননি ইউএনও। কিন্তু নিলামের আগে গাছ কাটা শুরু করা হয়েছে।

যশোর জেলা পরিষদের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য এবং অভয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আবদুর রউফ মোল্যা ওই গাছ কাটছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

জানতে চাইলে আবদুর রউফ মোল্যা বলেন, গাছ তিনটি সরকারি নয়, ব্যক্তিমালিকানাধীন। জমির মালিক বাড়ি করছেন। একটি গাছের কারণে তাঁর বাড়ির কাজ শেষ করতে সমস্যা হচ্ছে। তিনি তাঁর সীমানার তিনটি গাছ বিক্রি করে টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে চান। তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইউএনও বন বিভাগের মাধ্যমে গাছের মূল্য নির্ধারণ করেছেন। তিনি এখনো গাছ কাটার অনুমোদন দেননি। কিন্তু তিনি শ্রমিক দিয়ে একটি গাছের ডালপালা কেটে ফেলেছেন। তিনি বিষয়টি বুঝে উঠতে পারেননি। এটা ঠিক হয়নি।

গত রোববার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, অভয়নগর উপজেলা সদর নওয়াপাড়া থেকে একটি সড়ক মনিরামপুর উপজেলা সদরের সঙ্গে মিশেছে। সড়কটির নাম নওয়াপাড়া-মনিরামপুর সড়ক। সড়কটির নওয়াপাড়া থেকে সুন্দলী পর্যন্ত সাত কিলোমিটার সড়কের দুই পাশে বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য গাছ রয়েছে। সড়কটির নওয়াপাড়া থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে রানা ভাটার পাশে সড়ক ঘেঁষে একটি দোতলা বাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে।

নির্মাণাধীন বাড়ির সামনে সড়কের পাশে দুটি রেইনট্রিগাছ রয়েছে। বাড়ির পাশে সড়ক ঘেঁষে আরেকটি রেইনট্রিগাছ আছে। তিনটি গাছের কিছু অংশ ছাল তুলে সেখানে লাল কালি দিয়ে ১, ২ ও ৩ সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ নম্বর চিহ্নিত গাছের সব ডাল কাটা হয়েছে। ২ নম্বর চিহ্নিত গাছের দুটি ডাল বাদে সব ডাল কাটা হয়েছে। তবে ৩ নম্বর চিহ্নিত গাছের কোনো ডালপালা কাটা হয়নি। সেখান থেকে প্রায় ২০০ মিটার দূরে সড়কের পাশে আরেকটি বড় রেইনট্রিগাছের গোড়ার মাটি খুঁড়ে রাখা হয়েছে। গাছের কয়েকটি শিকড়ও কাটা হয়েছে।

জমির মালিক নওয়াপাড়া গ্রামের নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এই গাছ কাটার ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। জেলা পরিষদের সদস্য আবদুর রউফ মোল্যা এবং বন বিভাগের লোকজন বৃহস্পতিবার এসে তিনটি গাছ মার্কিং করে গেছেন। শনিবার কয়েকজন এসে গাছের ডালপালা কেটেছেন।’

শ্রমিক দিয়ে গাছ কেটেছেন ধোপাদী গ্রামের রাজু আহমেদ। তিনি বলেন, জেলা পরিষদের সদস্য আবদুর রউফ মোল্যা তাঁকে দুটি গাছ কেটে দিতে বলেছিলেন। এ জন্য শনিবার তিনি সাতজন শ্রমিক নিয়োগ করে গাছ কাটা শুরু করেছিলেন। একটা গাছের ডাল সম্পূর্ণ কাটা হয়েছে। অপর গাছের ডাল কাটার সময় বাধা আসে। এরপর তিনি শ্রমিকদের সেখান থেকে নিয়ে এসেছেন। আর যাননি।

জানা গেছে, ১৯৯৩ সালের ১ জুলাই তৎকালীন নওয়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) (বর্তমান নওয়াপাড়া পৌরসভার একাংশ এবং সুন্দলী ইউপি), বেসরকারি সংগঠন (এনজিও) ডেভেলপমেন্ট পার্টনার (ডিপি) এবং সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের সদস্যদের মধ্যে ২০ বছর মেয়াদি ত্রিপক্ষীয় একটি চুক্তি হয়। ২০১৩ সালের ১ জুলাই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে। চুক্তির প্রথম পক্ষ নওয়াপাড়া ইউপি, দ্বিতীয় পক্ষ ডেভেলপমেন্ট পার্টনার এবং তৃতীয় পক্ষ সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের সদস্যরা। সদস্যদের মধ্যে ৫২ জন নারী এবং একজন পুরুষ। ওই বছর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সহযোগিতায় তাঁরা নওয়াপাড়া-সুন্দলী সড়কের ৭ কিলোমিটার অংশের উভয় পাশে বিভিন্ন প্রজাতির ১৪ হাজারের বেশি গাছের চারা লাগান। চারার যত্ন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের সদস্যরা। চুক্তির শর্তানুযায়ী গাছ এবং গাছের ফল বিক্রির টাকা থেকে নওয়াপাড়া ইউপি ২০ শতাংশ, ডেভেলপমেন্ট পার্টনার ২০ শতাংশ এবং সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের সদস্যরা ৬০ শতাংশ টাকা পাবেন।

ডেভেলপমেন্ট পার্টনারের (ডিপি) পরিচালক কানিজ শবনব বলেন, অনেক আগেই মেয়াদ শেষ হলেও নানা জটিলতার কারণে গাছগুলোর ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি। যে গাছগুলো কাটা হচ্ছে, সেগুলো ডিপির লাগানো। গাছের মূল্য দেড় লাখ টাকার বেশি হবে। এ ব্যাপারে তাঁরা ইউএনওর কাছে লিখিত অভিযোগ দেবেন।

উপজেলা ভূমি কার্যালয় সূত্র জানা গেছে, ২ এপ্রিল ইউএনও ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) (অতিরিক্ত দায়িত্ব) কে এম আবু নওশাদ উপজেলা সামাজিক বন বাগান কেন্দ্রের ফরেস্টারকে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে তিনি উপজেলার নূরবাগ থেকে সুন্দলী সড়কসংলগ্ন রানা ভাটার পাশে তিনটি রেইনট্রিগাছ নিলামের মাধ্যমে বিক্রির জন্য সরকারি মূল্য নির্ধারণ করার অনুরোধ করেন। উপজেলা ফরেস্টার তিনটি গাছের মূল্য ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে ৪ এপ্রিল প্রতিবেদন দেন। এরপর ইউএনও গাছ তিনটির ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত দেননি।

এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য উপজেলা সামাজিক বন বাগান কেন্দ্রের ফরেস্টার হাফিজুর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে উপজেলা সামাজিক বন বাগান কেন্দ্রের বনপ্রহরী আলমগীর হোসেন বলেন, ‘ফরেস্টারের পক্ষে আমি তিনটি রেইনট্রিগাছের মূল্য নির্ধারণ করেছি। তিনটি গাছের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা। তবে গাছ তিনটির মূল্য এর চেয়ে বেশি হবে। মূল্য নির্ধারণে ভুল হয়েছে।’

অভয়নগরের ইউএনও কে এম আবু নওশাদ বলেন, গাছ কাটার বিষয়ে তিনি জানেন না। গাছ কাটার ব্যাপারে কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। এই অবস্থায় গাছ কাটার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে তা বন্ধ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।