উঁচু পাথুরে পাহাড়ের গা বেয়ে দুধসাদা পানির ধারা এসে পড়ছে নিচে। সেখানে খাদের গায়ে পানির ধারার আছড়ে পড়ার শোঁ শোঁ গর্জন হ্রদে ডুবে থাকা নির্জন পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। ঝরনা ঘিরে পানির ফোঁটায় তৈরি একটা কুয়াশার সাদা পর্দা। সেই পর্দা দুলে দুলে একবার সামনে, একবার পেছনে যাচ্ছে।
এমন অপার্থিব দৃশ্য দেখতে বহুদূরে পাড়ি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। রাঙামাটি জেলার সুবলং ঝরনা এখন এমন রূপ পেয়েছে। বর্ষায় যৌবন ফিরে পাওয়া এই ঝরনা দেখতে রাঙামাটি থেকে জলপথে মাত্র এক ঘণ্টার দূরত্ব পাড়ি দিতে হবে। তবে কেবল সুবলং নয়, আগামী কয়েক মাসে জেলার সাত থেকে আটটি ঝরনা এখন রূপের ডালি সাজিয়ে বসেছে। রাঙামাটিতে বেড়াতে এসে এই ঝরনাগুলো একবার ঘুরে এলে বলা যায়, পয়সা উশুল হবে ষোলো আনা।
যেসব ঝরনায় যাওয়া যাবে
সুবলংয়ের পাশাপাশি জেলায় এক ডজনের বেশি ঝরনা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হয়েছে ধুপপানি, চারিহং, শিলাছড়ি, হাজাছড়া, সিজকছড়া ও তৈমাছড়া ঝরনা। কোনো ঝরনায় যেতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা আবার কোনো কোনো ঝরনায় যেতে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়। সুবলং ঝরনা দেখতে গেলে একসঙ্গে দেখে আসা যায় চারিহং ঝরনাও। সদর উপজেলায় অবস্থিত এই ঝরনায় যেতে সময় লাগে দেড় ঘণ্টার মতো।
নৌযান নিয়ে রাঙামাটি থেকে কাপ্তাই হ্রদের জলপথ ধরে যাওয়া যায় বিলাইছড়ির ধুপপানি ঝরনায়। সময় লাগে দুই থেকে তিন ঘণ্টা। এ ছাড়া রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের কাউখালীতে তৈমাছড়া ঝরনা থেকে ঘুরে আসা যায় ৪৫ মিনিটে। নৌপথে পাঁচ ঘণ্টার যাত্রায় ঘুরে আসা যাবে লংগদুর আটারকছড়ার শিলাছড়িতে। এ ছাড়া যাঁরা বাঘাইছড়ির সাজেক পর্যটনকেন্দ্রে বেড়াতে যান, তাঁরা সেখানকার দুটি ঝরনা হাজাছড়া ও সিজক ঝরনা দেখে আসতে পারেন।
যাওয়ার আগে যা মাথায় রাখতে হবে
ঝরনায় বেড়াতে যাওয়ার আগে নিরাপত্তার বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। ঝরনার কাছাকাছি এসে পাথুরে পিচ্ছিল পথে না যাওয়াই ভালো। এ ছাড়া চিপসের প্যাকেট, পানীয়র বোতল, খাবারের প্যাকেট ফেলে পরিবেশ দূষিত করা যাবে না। দুর্গম এলাকায় যাওয়ার সময় অবশ্যই গাইড নিতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানিয়ে যেতে হবে। ঝরনায় গেলে অবশ্যই হড়পা বা হঠাৎ সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।
যা বলছেন ভ্রমণপিপাসুরা
সম্প্রতি সুবলং ঝরনায় গিয়ে কথা হয় আসামবস্তি গ্রামের বাবুল মারমা ও ঢাকার সাভার থেকে বেড়াতে আসা মো. সাব্বির হোসেনের সঙ্গে। তাঁরা জানান, ঝরনার দৃশ্য উপভোগ করার পাশাপাশি পানিতে নেমে গোসল করতে ভালো লাগে বেশির ভাগ পর্যটকের। তবে অনেকেই অসতর্ক থাকেন বলে দুর্ঘটনায় পড়েন। জেলায় অনেক সুন্দর ঝরনা থাকলেও সব কটি এখনো পর্যটকদের জন্য নিরাপদ নয়।
সুবলং ঝরনার টিকিট কাউন্টারের ব্যবস্থাপক নিরঞ্জয় চাকমা বলেন, প্রতিবছর মাত্র তিন থেকে চার মাস ঝরনাটিতে পানি থাকে। ছয় মাস কোনো পানি থাকে না। এখন ভরা বর্ষায় পর্যটকের ভিড় রয়েছে। সরকার উদ্যোগ নিলে এখানে সারা বছর পানি থাকবে, পর্যটকও আসবে।
পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ও বার্গি লেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুমেদ চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, রাঙামাটিতে প্রতিবছর প্রচুর পর্যটক আসেন। কিন্তু নিরাপদ পরিবেশ তৈরিতে কেউ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। রাঙামাটিতে বেশ আকর্ষণীয় ঝরনা রয়েছে। সঠিক ব্যবস্থাপনা থাকলে সেসব ঝরনায় বহু পর্যটক আসতেন।
বরকলে অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আরাফাত মোহাম্মদ নোমান প্রথম আলোকে বলেন, রাঙামাটির বরকলের সুবলং ঝরনাটি উপজেলা প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করে। অবকাঠামো ও পর্যটকদের সুবিধার্থে উন্নয়ন হয়েছে। কীভাবে আরও উন্নয়ন করা যায়, তা নিয়ে চিন্তা রয়েছে প্রশাসনের।