উন্নয়ন না হওয়ায় আটকে আছে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের অপার সম্ভাবনা

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর। সম্প্রতি তোলা
 ছবি: প্রথম আলো

চতুর্দেশীয় বাণিজ্যের দুয়ার পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রতিবছর আমদানি-রপ্তানি বাড়লেও এ বন্দরের আয়তন বাড়েনি; হয়নি কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন। জায়গার অভাবে গাড়ি পার্কিং, পণ্য ওঠানো-নামানোসহ নানা ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধান করতে পারলে বন্দরটি আরও গতিশীল হবে। এতে রাজস্ব ও রপ্তানি আয়ও বাড়বে কয়েক গুণ।

৪ জুন দুপুরে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে গিয়ে দেখা যায়, ভারত থেকে আমদানি পণ্য নিয়ে বন্দরে ঢুকছে একের পর এক ট্রাক। ওজন স্কেলে পণ্যসহ পরিমাপ করা হচ্ছে এসব গাড়ি। অন্যদিকে রপ্তানি পণ্য নিয়ে ভারতে যাওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি ট্রাক। বন্দরের ইয়ার্ডে শ্রমিকেরা ব্যস্ত আমদানি করা পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজে। একই সঙ্গে ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে ভিড় করছেন ভারতগামী ও ভারতফেরত যাত্রীরা। তবে বন্দরের ইয়ার্ডে জায়গাস্বল্পতার কারণে গাড়িগুলোর ঢুকতে ও বের হতে বেশ সময় লাগছে। পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থার উন্নয়ন না হওয়ায় ভারী বৃষ্টি হলেই বন্দরের বিভিন্ন স্থানে পানি জমে থাকছে।

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক। সম্প্রতি তোলা

বন্দরের এসব সমস্যা সমাধানে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, তা জানতে চাইলে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর লিমিটেডের ব্যবস্থাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ভৌগোলিক অবস্থান ও কৌশলগত কারণে এটি দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্দর। এ স্থলবন্দরে প্রতিবছরই বাড়ছে আমদানি-রপ্তানি। তবে বন্দরটিতে পণ্য রাখার জায়গা সংকুলান হচ্ছে না। সেই সঙ্গে বৃষ্টি হলে বা বর্ষার দিনে বন্দরের ভেতরে জমে থাকা পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় কিছুটা বিপাকে পড়তে হয়। তবে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে এখানে আরও সাড়ে ১৬ একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। এ প্রক্রিয়া শেষ হলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না।

পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে এখনো কোনো নির্দেশ পাইনি। বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পেলে সেই অনুযায়ী স্থলবন্দরের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হবে।’

পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক ডিজিটাল স্কেলে ওজন দেওয়া হয়। সম্প্রতি তোলা

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৯৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর নেপালের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য কার্যক্রম শুরুর মধ্য দিয়ে চালু হয় বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর। এরপর ২০১১ সালের ২২ জানুয়ারি এ স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের সঙ্গেও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি এ বন্দর দিয়ে ভারতে যাত্রী পারাপার শুরু হয়। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে ভুটানের সঙ্গে শুরু হয় পণ্য আমদানি-রপ্তানি। বন্দরের কার্যক্রম ব্যবস্থাপনায় ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ ২৫ বছরের জন্য বেসরকারি পোর্ট অপারেটর হিসেবে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর লিমিটেডকে নিযুক্ত করেছে।

বাংলাবান্ধা শুল্ক স্টেশন সূত্রে জানা যায়, ভারত, নেপাল ও ভুটান থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৭ লাখ ৬৭ হাজার ৬৬৪ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি ও বাংলাদেশ থেকে ৮৭ হাজার ৬৩৩ মেট্রিক টন পণ্য রপ্তানি হয়েছে। দিনে অন্তত ২০০টি ট্রাকে পণ্য আমদানি এবং অন্তত ১০০টি ট্রাকে পণ্য রপ্তানি হয়। বর্তমানে এই বন্দর দিয়ে আমদানি করা পণ্যের মধ্যে প্রায় ৯৮ শতাংশ পাথর। এ ছাড়া মসুর ডাল, গম, ভুট্টা, চিরতা, হাজমলা, যন্ত্রপাতি, প্লাস্টিকদানা, রেললাইনের স্লিপার, খইল, আদা ও চিটাগুড় আমদানি করা হয়। এ বন্দর দিয়ে ভারত ও নেপালে পাট, ওষুধ, প্রাণ ও ওয়ালটনের পণ্য, জুস, মোটরসাইকেল, ব্যাটারিসহ নানা ধরনের পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।

গত ২০২০-২১ অর্থবছরে এই বন্দর থেকে ৬৩ কোটি ১৫ লাখ টাকার রাজস্ব আয় হয়েছে। এরপর প্রতি অর্থবছরই রাজস্ব আয় বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ৬৬ কোটি ১১ লাখ টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বন্দরের জায়গা সম্প্রসারণ, পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ও অবকাঠামো উন্নয়ন করা হলে এবং ভারতের সঙ্গে প্রায় ২৬টি পণ্য আমদানিতে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারসহ নানা জটিলতা নিরসনে সরকার উদ্যোগী হলে এ বন্দর দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের আরও বেড়ে যাবে।

বাংলাবান্ধা শুল্ক স্টেশন সূত্রে জানা যায়, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে এই বন্দর থেকে ৬৩ কোটি ১৫ লাখ টাকার রাজস্ব আয় হয়েছে। এরপর প্রতি অর্থবছরই রাজস্ব আয় বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ৬৬ কোটি ১১ লাখ টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে।

স্থলবন্দর মাত্র ১০ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে। চার দেশের মধ্যে পণ্য আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ, ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে যাত্রীদের আনাগোনা ও শ্রমিকদের বহুমুখী কাজের কথা চিন্তা করে কমপক্ষে ৫০ একর জমিতে বন্দরটি গড়ে তোলা উচিত।
কুদরত-ই-খুদা মিলন, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপ

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক কুদরত-ই-খুদা মিলন বলেন, স্থলবন্দর মাত্র ১০ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে। চার দেশের মধ্যে পণ্য আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ, ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে যাত্রীদের আনাগোনা ও শ্রমিকদের বহুমুখী কাজের কথা চিন্তা করে কমপক্ষে ৫০ একর জমিতে বন্দরটি গড়ে তোলা উচিত। সেই সঙ্গে বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন হলে এবং ভারত থেকে যেসব পণ্য আমদানির স্থগিতাদেশ রয়েছে, তা তুলে নিলে এটি আরও সচল হবে এবং রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়বে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, একটি বন্দর সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য অন্তত ৫০ একর জমির প্রয়োজন। আর চলমান ডলার-সংকটসহ নানা সমস্যায় বিপাকে পড়তে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এ ছাড়া ভারতীয় হাইকমিশন বেশ কিছুদিন ধরে এই বন্দরের ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে (বাংলাবান্ধা-ফুলবাড়ী রুট) ভিসা দেওয়া সীমিত করায় কমেছে যাত্রী পারাপারও। এতে অনেক সময় ভারতে যাতায়াতের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদেরও বিপাকে পড়তে হয়।

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, স্থলবন্দরের জায়গা সম্প্রসারণ করা হলে গাড়ি থেকে পণ্য খালাস দ্রুত হবে। তাহলে একটির পর একটি গাড়িকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। এ ছাড়া পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় বন্দরের ইয়ার্ডের পূর্ব দিকে ২ ও ৩ নম্বর ফটকে পানি জমে থাকে। এতে যাতায়াত ও পণ্য খালাসে সমস্যা সৃষ্টি হয়।

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর লিমিটেডের ব্যবস্থাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, বর্তমানে বন্দরের ১ ও ২ নম্বর ফটক দিয়ে আমদানি করা পণ্য নিয়ে গাড়িগুলো ঢোকে আর ৩ নম্বর ফটক দিয়ে বের হয়ে যায়। আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে গেলে গাড়ির চাপ বাড়ে। এতে জায়গাসংকট দেখা দেয়। চতুর্দেশীয় স্থলবন্দর বিবেচনায় এ বন্দরে ভবিষ্যতে আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। তার জন্য এ বন্দরের আয়তন আরও বাড়ানো জরুরি। আয়তনের পরিধি বৃদ্ধি পেলে বন্দরটির সব কার্যক্রম আরও সমৃদ্ধ হবে এবং সব সংকটের সমাধান হবে।

স্থলবন্দরের কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা বাংলাবান্ধা ইউনিয়নে মহানন্দা নদীর তীর ঘেঁষে ও ভারত-বাংলাদেশের শূন্যরেখাসংলগ্ন ১০ দশমিক ৪৮ একর জায়গাজুড়ে গড়ে উঠেছে এ স্থলবন্দর। ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যোগসূত্র থাকায় পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে বিপুল সম্ভাবনা জাগিয়েছে বন্দরটি। এতে যুক্ত হয়েছে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ।