‘এক দিন কাজে না গেলে সংসার চলত না। সব সময় পোলাপানের লেখাপড়া আর ভবিষ্যৎ লইয়া ভাবত। এই মানুষটারেই জানে মাইরা ফালাইল। এখন সংসার চলাইব কে? পোলাপানরে মানুষ করমু ক্যামনে? তিনটা বাচ্চা লইয়া কই যামু, কী করমু!’
আজ রোববার দুপুরে আহাজারি করে এসব কথা বলছিলেন মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলায় ফার্নিচারের নকশা করা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে নিহত মোস্তফা খালাসীর (৪২) স্ত্রী সালমা আক্তার।
মোস্তফা খালাসী উপজেলার যশলং ইউনিয়নের হাটকান গ্রামের সফি উদ্দিন খালাসীর ছেলে। তিনি উপজেলার বাঘিয়া বাজারে ফার্নিচারের নকশার কাজ করতেন। সদর উপজেলার মোল্লাকান্দি ইউনিয়নের ঢালীকান্দি এলাকার বাসিন্দা রাজন সিকদারের বিরুদ্ধে মোস্তফা খালাসীকে হত্যার অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, ১৫ বছর আগে মোস্তফা খালাসী ও সালমার বিয়ে হয়। এই দম্পতির ঘরে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া জান্নাতুল ফেরদৌস (১৪), ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া সামি খালাসী (১২) ও ১১ মাস বয়সী সাবিহা ফেরদৌস নামের তিন সন্তান আছে।
দুপুর ১২টার দিকে মোস্তফার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, এক কক্ষের এক চালা ঘর। ঘরটির দরজার সামনে ছোট্ট সাবিহাকে কোলে নিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলেন সালমা। তাঁর দুই পাশে বসা ছিল সামি ও জান্নাতুল। বাড়িতে প্রতিবেশী ও স্বজনেরা আসা–যাওয়া করছিলেন। সবাই সালমা ও তাঁর সন্তানদের নানাভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। সালমা ও তাঁর স্বজনেরা আহাজারি করছেন। আক্ষেপ করে সালমা বলেন, তাঁর স্বামী সারা দিন ফার্নিচারে নকশা করে যা টাকা পেতেন, তা দিয়ে কোনো রকমে সংসার ও তিন ছেলেমেয়ের পড়ালেখার খরচ চলত। কারও সঙ্গে কোনো ঝামেলায় জড়াতেন না। আর সেই মানুষকে মেরে ফেলা হলো।
আহাজারি করে সালমা আক্তার বলেন, তাঁদের ঘরে অভাব ছিল। তবে সংসারে কোনো অশান্তি ছিল না। বিয়ের পর অভাবে কষ্ট করছেন, তবে তাঁর স্বামী কখনো কষ্ট দেননি। তাঁদের একটু ভালো রাখার জন্য মানুষটা দিনরাত পরিশ্রম করতেন। মানুষটা ছিলেন তাঁদের প্রধান ভরসা। সেই মানুষটা শেষ হয়ে গেলেন। ভাঙা একটি ঘর ছাড়া তাঁদের কিছুই নেই। স্বামীকে হারিয়ে বাচ্চাদের নিয়া পথে বসা ছাড়া কোনো উপায় দেখছেন না তিনি।
আক্ষেপ করে সালমা আরও বলেন, ‘সামান্য নকশা করা নিয়ে কথা-কাটাকাটি হইতে পারে। কিন্তু একটা তাজা মানুষরে কেমনে মাইরা ফালাইল! যে আমার স্বামীরে মারল, আমাদের পথে বসাইল, আমি তার বিচার চাই।’
নিহত মোস্তফার মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস বলে, ‘বাবা আমাদের অনেক আদর করত। বাবার মতো যেন কষ্ট করতে না হয়, এ জন্য আমাদের পড়াশোনা করিয়ে বড় অফিসার বানাতে চেয়েছিল বাবা। শনিবার ভোরে বাবার সঙ্গে সাহ্রি খেয়েছি। সেটাই ছিল বাবার সঙ্গে শেষ দেখা। ঘুম থেকে উঠে দেখি, বাবা কাজে চলে গেছে। পরে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শুনি, বাবাকে মেরে ফেলেছে। যে আমার বাবাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, আমাদের এতিম করেছে, আমরা তার বিচার চাই।’
কয়েক প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গতকাল সকালে বাঘিয়া বাজারে ফার্নিচারের নকশা করার জন্য মোস্তফার দোকানে কাঠ নিয়ে আসেন রাজন। রাজন তাঁর কাঠে নকশা করে দিতে বলেন মোস্তফাকে। রোজা রেখেছেন, হাতে কাজ আছে, বিদ্যুৎও থাকবে না জানিয়ে মোস্তফা নকশা করে দিতে পারবেন না বলে জানান রাজনকে। রাজন বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি। এ নিয়ে দুজন তর্কে জড়ান। রাজনের কাঠ দোকান থেকে বাইরে ছুড়ে ফেলে দেন মোস্তফা। একপর্যায়ে রাজন ও মোস্তফা হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন। পরে তাঁদের দুজনকে দুই দিকে ছাড়িয়ে দেন পাশের দোকানের লোকজন। সে সময় মোস্তফা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। পরে দোকানে লাশ রেখে পালিয়ে যান রাজন। স্থানীয় লোকজন দোকানে লাশ দেখে পুলিশে খবর দেন। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশটি উদ্ধার করে।
ওই বাজারের এক দোকানদার বলেন, ‘মোস্তফা যখন মাটিতে পড়ে যায়, তখন আমি তার কাছে গিয়েছিলাম। মোস্তফা বলেছে, রাজন তার অণ্ডকোষে চাপ দিয়েছে। বলতে বলতেই সে মারা যায়।’
নিহত মোস্তফা খালাসীর লাশ ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় হাটকান সামাজিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। এ ঘটনায় আজ রোববার সকালে সালমা বাদী হয়ে টঙ্গিবাড়ী থানায় হত্যা মামলা করেন। স্থানীয় লোকজন এ ঘটনার হোতা রাজন সিকদারের ফাঁসির দাবি তুলেছেন।
ঘটনার সঙ্গে জড়িত রাজন সিকদারকে গ্রেপ্তারে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে বলে জানিয়েছেন টঙ্গিবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোল্লা সোয়েব আলী।