দিনাজপুরে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) জেনেটিকস অ্যান্ড অ্যানিমেল ব্রিডিং বিভাগের গবেষণাগারে ইনকিউবেটরে উটপাখির ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো হয়েছে। দেড় মাস আগে ইনকিউবেটরে ১৯টি ডিম বসানো হয়েছিল। সেখান থেকে গত মঙ্গলবার একটি ডিম থেকে বাচ্চা ফুটেছে। বাচ্চাটির ওজন ৯৪৮ গ্রাম।
বৃহস্পতিবার জেনেটিকস অ্যান্ড অ্যানিমেল ব্রিডিং বিভাগের গবেষণাগারে গিয়ে দেখা যায়, ইনকিউবেটরে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় একটি তাকে ট্রেতে সাজানো সারি সারি উটপাখির ডিম। নিচের ট্রেতে চুপটি মেরে বসে আছে একটি উটপাখির ছানা। গায়ে ধূসর রঙের মসৃণ হালকা লোম। শব্দ পেয়ে এদিক-সেদিক উঁকি দিয়ে যাচ্ছে ছানাটি। পিএইচডি গবেষক খন্দকার তৌহিদুল ইসলাম ইনকিউবেটর থেকে ছানাটি বের করে টেবিলে রেখে শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করছেন।
আড়াই বছর ধরে উটপাখির বংশবৃদ্ধি, বাণিজ্যিকভাবে উটপাখির চাষ করে দেশে প্রোটিনের জোগান দেওয়া বিষয়ে খন্দকার তৌহিদুল ইসলাম গবেষণা করছেন বলে জানালেন। তিন দফায় অর্ধশতাধিক ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর চেষ্টার দীর্ঘ অপেক্ষার পরে সফলতা পেয়ে চোখেমুখে আনন্দের ছাপ তাঁর। এ গবেষণার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিকস অ্যান্ড অ্যানিমেল ব্রিডিং বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান এম এ গাফফার, সুপারভাইজার উম্মে সালমা, বর্তমান চেয়ারম্যান রাশেদুল ইসলাম ও উটপাখির খামারি এলমিস অটোরাইস মিলের স্বত্বাধিকারী সুলতান ইফতেখার ওয়ালী।
পোলট্রিবিজ্ঞান বিষয়ে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন খন্দকার তৌহিদুল ইসলাম। ২০২১ সালে ‘প্রোডাক্টিভ অ্যান্ড রিপ্রোডাক্টিভ পাওয়ার সেন্স অব অস্ট্রিস ইন বাংলাদেশ’ বিষয়ে গবেষণায় আগ্রহী হন তিনি। তবে তাঁর গবেষণার দ্বার উন্মোচন করেন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান এম এ গাফফার (বর্তমানে তিনি রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটির উপাচার্য)। এম এ গাফফার ২০১৫ সালে সাউথ আফ্রিকা থেকে ২১টি উটপাখির বাচ্চা এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি ভবন–সংলগ্ন এক বিঘা জমিতে খামার স্থাপন করে গবেষণা শুরু করেন। ১৮ দিন বয়সী ২১টি বাচ্চা বড় হয়ে ডিম দিয়েছে। সেই ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো সফল হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক আবহাওয়ায় উটপাখির টিকে থাকা ও প্রজনন বৃদ্ধি করার বিষয়ে এম এ গাফফারের গবেষণা অব্যাহত আছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোলাহল পরিবেশে গবেষণা বাধাগ্রস্ত হওয়া ও শিক্ষার্থীদের গবেষণায় ব্যাঘাত ঘটা থেকে ২০২১ সালে খামারি ও ব্যবসায়ী সুলতান ইফতেখার ওয়ালীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়।
এ বিষয়ে অনুভূতি জানতে চাইলে মুঠোফোনে এম এ গাফফার বলেন, গত মঙ্গলবার বিভাগের এক শিক্ষক ফোন করে উটপাখির বাচ্চা হওয়ার কথা জানান। একজন গবেষকের জন্য এ যে কত বড় আনন্দের, তা বলে বোঝানো যাবে না। সাফারি পার্কে উটপাখির দেওয়া ডিম থেকে প্রাকৃতিকভাবে বাচ্চা ফুটিয়েও বাঁচানো যায়নি। নরসিংদীতে একটি ফার্মেও সফল হওয়া যায়নি। প্রথমবারের মতো হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয় ইনকিউবেটরে বাচ্চা ফোটাতে সফল হয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে উটপাখির বংশবিস্তারে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হলো। একটি উটপাখির বাচ্চা আমদানিতে খরচ হতো ৪০-৫০ হাজার টাকা। এ সফলতা ধরে রাখতে পারলে ১০-১৫ হাজার টাকায় একেকটি বাচ্চা আগ্রহী খামারিদের দেওয়া সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক আবহাওয়ায় উটপাখির টিকে থাকা ও প্রজনন বৃদ্ধি করার বিষয়ে এম এ গাফফারের গবেষণা অব্যাহত আছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোলাহল পরিবেশে গবেষণা বাধাগ্রস্ত হওয়া ও শিক্ষার্থীদের গবেষণায় ব্যাঘাত ঘটা থেকে ২০২১ সালে খামারি ও ব্যবসায়ী সুলতান ইফতেখার ওয়ালীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। এরপর উটপাখিগুলো তাঁর খামারে লালন–পালন হতে থাকে। ওই খামারে উৎপাদিত ডিম থেকেই বাচ্চা ফোটানো হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার সূত্রে জানা যায়, উটপাখির বৈজ্ঞানিক নাম Struthio Camelus। এর জন্মস্থান আফ্রিকা অঞ্চলে। পাখিজগতের সব প্রজাতির মধ্যে উটপাখি বৃহত্তম। অনেক বছর আগে উত্তর আফ্রিকা, সাহারার দক্ষিণাঞ্চল, পূর্ব আফ্রিকা, দক্ষিণ আফ্রিকার উডল্যান্ড এবং এশিয়া মাইনর উটপাখির আবাসস্থল হলেও বর্তমানে দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকার মরুভূমি অঞ্চলে এর বসবাস। মরুভূমির উষ্ণ আবহাওয়ায় উটপাখির প্রচণ্ড গরম সহ্য করার ক্ষমতা যেমন আছে, তেমনি বৃষ্টি ও শীতপ্রধান এলাকাতেও উটপাখি সহজেই খাপ খাইয়ে চলতে পারে। উটপাখির একটি ডিমের ওজন এক-দুই কেজি পর্যন্ত হয়। প্রাপ্তবয়স্ক উটপাখির ওজন ৮০-১৫০ কেজি এবং উচ্চতা ১ দশমিক ৮ থেকে ২ দশমিক ৮ মিটার। সাধারণত ঘাস, লতাপাতা, ফলমূল, শস্যদানা, ছোট ছোট পোকামাকড় এদের প্রধান খাদ্য। অন্যান্য প্রাণীর মাংসের তুলনায় এর চর্বি ও কোলেস্টেরল কম থাকে এবং সুস্বাদু। সাধারণত আড়াই বছর বয়সে স্ত্রী পাখি ডিম দেওয়া শুরু করে। মার্চ-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিম দেওয়ার সময়কাল। মৌসুমে একেকটি উটপাখি ৬০-৮০টি পর্যন্ত ডিম দেয়। ডিম থেকে বাচ্চা ফোটাতে সময় লাগে ৪০-৪২ দিন।
খামারি সুলতান ইফতেখার ওয়ালী বলেন, উটপাখিসহ বিলুপ্তপ্রায় নানা পশুপাখি তাঁর খামারে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-গবেষক তাঁদের গবেষণাকাজে খামারে আসছেন। এতে তাঁর ভালোই লাগে। খামারে এখন ১৪টি উটপাখি রয়েছে। পাখি ডিম পাড়লেই গবেষণাগারে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
উটপাখি গবেষণার সুপারভাইজনার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স অনুষদের ডিন উম্মে সালমা বলেন, ‘উটপাখি হচ্ছে প্রোটিনের একটি অন্যতম সোর্স। দেশে প্রোটিনের জোগান দিতে প্রথমবারের মতো উটপাখির বংশবিস্তারে আমরা সফলতা পেয়েছি। এটি শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সারা দেশের গবেষণা খাতের সফলতা। এটি অব্যাহত থাকলে স্বল্প খরচে খামারিদের আমরা বাচ্চা সরবরাহ করতে পারব এবং বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হব। একই সঙ্গে প্রোটিনের চাহিদার জোগান দেওয়া সম্ভব হবে।’