স্বামীর মৃত্যুর পর বৃদ্ধা রোকেয়া বেগমের খোঁজখবর নেওয়া বন্ধ করে দেন দুই ছেলে। কখনো আধপেটা, কখনো না খেয়ে দিন কাটছিল তাঁর। কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না রোকেয়ার। অর্ধাহারে–অনাহারে অনেক কষ্টে দিন কাটছিল তাঁর। এমন সময় ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডুর ইসমত আরার বৃদ্ধাশ্রমের খোঁজ পান তিনি। থাকা–খাওয়ার সুযোগ থাকায় সুদূর কুষ্টিয়া শহর ছেড়ে আশ্রয় নেন সেই বৃদ্ধাশ্রমে।
ফরিদপুরের রাশিদা বেগম বিয়ের পর দুই বছর সংসার করেছেন। স্বামী তাঁকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। বাবার মৃত্যুর পর ভাইয়েরা তাঁর ভরণপোষণ করতে চাননি। কষ্ট করে নিজেই উপার্জন করতেন। এখন উপার্জন বন্ধ, যাওয়ার জায়গাও নেই। এ অবস্থায় তিনিও আশ্রয় নিয়েছেন ওই বৃদ্ধাশ্রমে।
বৃদ্ধাশ্রম শুরুর প্রথম দিকে মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হতো। নিজের হস্তশিল্প কারখানার আয় দিয়ে ওই খরচ মেটাতেন। স্বামীর আয়ে চলেছে সংসার আর তাঁর আয়ে চলেছে বৃদ্ধাশ্রম।ইসমত আরা, বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা
রোকেয়া-রাশিদার মতো ২২ জন বৃদ্ধার ইসমত আরার বৃদ্ধাশ্রমে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে। যাঁরা তিন বেলা খাবারের পাশাপাশি পরনের কাপড় পাচ্ছেন। তেল-সাবান সবই দিচ্ছেন ইসমত আরা। সবাই মিলে প্রতিদিন নিয়ম করে গল্প বলার আসর বসানো হয় বৃদ্ধাশ্রমে। ইসমত আরা (৫৫) ঝিনাইদহ হরিণাকুণ্ডু উপজেলার জোড়াপুকুরিয়া গ্রামের মৃত শফি উদ্দিন বিশ্বাসের স্ত্রী।
হঠাৎ বৃদ্ধাশ্রম চালু করার মতো জনসেবামূলক কাজ করার চিন্তা মাথায় এল কীভাবে, জানতে চাইলে ইসমত আরা প্রথম আলোকে বলেন, বেশ কিছু বছর আগে পুত্রবধূদের লাঞ্ছনা-বঞ্চনা সহ্য না করতে পেরে প্রতিবেশী এক বৃদ্ধা কীটনাশক পান করেছিলেন। চিকিৎসায় ওই নারী বেঁচে ফিরলেও তাঁকে বাড়িতে আশ্রয় দেননি সন্তানেরা। অসহায় অবস্থা দেখে ওই নারীকে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দেন তিনি। এরপর পাড়ার আরও দুই-তিনজন বৃদ্ধা তাঁর কাছে আশ্রয় নেন। এ ঘটনার পর তাঁর মাথায় বৃদ্ধাশ্রম তৈরির ভাবনা আসে।
ইসমত আরার বৃদ্ধাশ্রমে প্রথম বেড়ার ঘরে যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন নিমরী খাতুন, কাজলী বেগম, জহিরন নেছা, পায়রা বেগম, ওজলা খাতুন, নেকজান বিবি, ভানু বিবি, রাশিদা খাতুন, জহুরা বেগম, রেবেকা খাতুন, জেয়ারত বেগম, ছবিরন নেছা ও বিলকিস বেগম।
ইসমত আরা জানান, ২০০৯ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বৃদ্ধাশ্রমের কাজ শুরু করেন। স্বামীর দেওয়া তিন শতক জমিতে নিজ খরচে একটি টিনের ঘর বানান। থাকার ব্যবস্থা করার পর একে একে ১৩ জন বৃদ্ধা চলে আসেন। তিনি নিজে হাতের কাজ করতেন। পাশাপাশি বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করে যে আয় হতো, তা দিয়ে বৃদ্ধাদের খাবারসহ অন্যান্য খরচ মেটানো হতো। তাঁর স্বামীও প্রতি মাসে কিছু টাকা দিতেন। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমে তিনি কাজটি করে যাচ্ছেন।
ইসমত আরার বৃদ্ধাশ্রমে প্রথম বেড়ার ঘরে যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন নিমরী খাতুন, কাজলী বেগম, জহিরন নেছা, পায়রা বেগম, ওজলা খাতুন, নেকজান বিবি, ভানু বিবি, রাশিদা খাতুন, জহুরা বেগম, রেবেকা খাতুন, জেয়ারত বেগম, ছবিরন নেছা ও বিলকিস বেগম। পরে তাঁদের সঙ্গে নতুন আরও নয়জন যুক্ত হন। বর্তমানে মোট ২২ জন বৃদ্ধা থাকছেন ওই বৃদ্ধাশ্রমে।
ইসমত আরা বলেন, বৃদ্ধাশ্রম শুরুর প্রথম দিকে মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হতো। পল্লী নকশা নামের নিজের হস্তশিল্প কারখানার বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে যে টাকা আয় করতেন, তা দিয়ে ওই খরচ মেটাতেন। স্বামীর আয়ে চলেছে সংসার, আর তাঁর আয়ে চলেছে বৃদ্ধাশ্রম।
ইসমত আরা আরও বলেন, এখন বৃদ্ধাশ্রমের পরিধি বেড়েছে। জেলা পরিষদ ২২ লাখ টাকা ব্যয় করে ২০১৯ সালে তিন কক্ষের একটি পাকা ঘর বানিয়ে দিয়েছে। সেখানে বৃদ্ধারা আরামে থাকতে পারছেন। বর্তমানে বৃদ্ধাশ্রমে ব্যয়ও বেড়েছে। এখন মাসে ৩০০ কেজি চাল লাগে। সাপ্তাহিক বাজার লাগে সাড়ে ৪ হাজার টাকার। তেল, সাবানসহ প্রসাধনসামগ্রীতে মাসে খরচ হয় আড়াই হাজার টাকা। এ ছাড়া বৃদ্ধা নারীদের ওষুধ, কাপড়, বিদ্যুৎ বিলসহ বিভিন্ন খরচ রয়েছে। সব মিলিয়ে মাসে প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। বৃদ্ধাদের পরনের কাপড় জাকাতের কাপড় থেকে হয়ে যায় বলে তিনি জানান।
শুরু থেকেই বৃদ্ধাশ্রমে আছেন নিমরী খাতুন। তিনি বলেন, বৃদ্ধাশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করতে অনেক কষ্ট করেছেন ইসমত আরা। এখনো করে যাচ্ছেন। নিজের ব্যবসার সব আয় বৃদ্ধাশ্রমে ব্যয় করছেন। হাতের কাজের কারখানার আয়ও বৃদ্ধাশ্রমে খরচ হচ্ছে। এ ছাড়া এলাকার কিছু মানুষ সহযোগিতা করেন।
ইসমত আরা প্রথম আলোকে বলেন, অসহায় নারীরা ধর্মীয় বই পড়েন ও গল্প করে সময় কাটান। নামাজের সময় হলে সবাই একত্রে নামাজে চলে যান। তাঁদের আরবি পড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পালাক্রমে নিজেদের রান্না করা ছাড়া তাঁদের কোনো কাজ করতে হয় না। নিয়ম করে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম—সবই দেওয়া হয় তাঁদের। বিনিময়ে তাঁদের ভালোবাসা পাচ্ছেন তিনি।
হরিণাকুণ্ডু পৌরসভার মেয়র ফারুক হোসেন বলেন, সময় পেলেই মাঝেমধ্যে তিনি বৃদ্ধাশ্রমে যান। ইসমত আরার বৃদ্ধাশ্রমটি অজপাড়াগাঁয়ের একটি মডেল হয়ে গেছে। এলাকার বৃদ্ধারা এখন আর নিজেদের অসহায় মনে করেন না। পরিবারে সমস্যা হলে আশ্রয় নেন বৃদ্ধাশ্রমে।