স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত ৭৫০ ফুটের ওই সেতুতে স্থানীয় বাসিন্দাদের যাতায়াত সহজ হয়েছে। সুবিধা হয়েছে পর্যটকদেরও।
নেত্রকোনার দুর্গাপুরের গাঁকান্দিয়া, কুল্লাগড়া, কাকৈইগড়া ও বিরিশিরি ইউনিয়নের আংশিক এলাকার প্রায় ৮০ হাজার মানুষের উপজেলা সদরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রায় ৯০০ মিটার প্রশস্ত সোমেশ্বরী নদী উপজেলা সদরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন এলাকাগুলোর মানুষদের দূরে রেখেছিল। সেই দূরত্ব ঘুচল শিবগঞ্জ খেয়াঘাটে নির্মিত একটি অস্থায়ী কাঠের সেতুতে।
স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত ৭৫০ ফুটের ওই সেতুতে স্থানীয় বাসিন্দাদের যাতায়াত সহজ হয়েছে। সুবিধা হয়েছে পর্যটকদেরও। সারিবদ্ধ সাদা মাটির পাহাড়, রানীখং টিলায় নান্দনিক ক্যাথলিক মিশন কিংবা হাজংমাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধ অথবা ঝরনার মতো বয়ে চলা সোমেশ্বরীর স্বচ্ছ জলধারা দেখতে কোনো বেগ পেতে হয় না। আগে এ পথ পারাপারের একমাত্র উপায় ছিল নৌকা।
সেতুটির নির্মাণকাজে অর্থায়ন করেছেন কেন্দ্রীয় বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল। তিনি বলেন, ‘মানুষের কষ্ট সাময়িকের জন্য হলেও লাঘবের চেষ্টা করা হয়েছে। আর বড় কথা হচ্ছে, ইচ্ছাশক্তি থাকলে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ভালো কিছু করা সম্ভব, এ সেতু নির্মাণ এরই বাস্তব উদাহরণ। এর সঙ্গে যাঁরা জড়িত রয়েছেন, সবাই ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখেন।’
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রকৃতি আর সংস্কৃতির সংমিশ্রণে অপরূপ লীলাভূমি দুর্গাপুরের আয়তন ২৭৮ দশমিক ২৮ বর্গকিলোমিটার। সেখানে প্রায় ২ লাখ ৩৫ হাজার মানুষের বসবাস। কিন্তু পাহাড় থেকে নেমে আসা দুর্গাপুর পৌর শহর দিয়ে বয়ে চলা সোমেশ্বরী নদী প্রায় চারটি ইউনিয়নকে বিভাজন করে দিয়েছে। ওই ইউনিয়নগুলোর মানুষকে চৈতাটি, ভবানীপুর ও শিবগঞ্জ ফেরীঘাট দিয়ে নদী পারাপার হয়ে উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়।
বিশেষ করে শিবগঞ্জ ঘাট দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার মানুষ যাতায়াত করে। কারণ, সহজ হওয়ায় ওই পথ দিয়ে পাশের ময়মনসিংহের ধোবাউড়া এবং হালুয়াঘাটের মানুষ ছাড়া ভ্রমণপিপাসুরাও চলাচল করেন। কিন্তু সেখানে স্থায়ী সেতু না থাকায় বছরের প্রায় ছয় মাস নদীতে নৌকায় ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হতে হয়। আর শুকনা মৌসুমে নদীতে পানি কমে যাওয়ায় পারাপারে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কখনো ধু ধু বালুর ওপর দিয়ে হেঁটে, কখনো হাঁটুপানি পাড়ি দিয়ে নৌকায় উঠতে হয়।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এবার এই দুর্ভোগ লাঘবে উদ্যোগী হন কেন্দ্রীয় বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল। তাঁর পরিকল্পনা ও অর্থায়নে এলাকার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে ৭৫০ মিটার এ কাঠের সেতু নির্মাণ করেছেন। অস্থায়ী এই সেতুর সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছেন তেরীবাজার বড় মসজিদের খতিব মুফতি মাওলানা আবদুর রব, কুল্লাগড়া রামকৃষ্ণ আশ্রমের সম্পাদক প্রভাত চন্দ্র সাহা এবং খ্রিষ্টান মিশনারিজের প্রতিনিধি পঙ্কজ সাংমা।
গত শুক্রবার দুপুরে সেতু পার হতে গিয়ে দেখা যায়, ফেরীঘাটে অর্থাৎ নদীর এপাড়-ওপাড়ে বড় করে বিলবোর্ড সাঁটানো রয়েছে। তাতে লেখা আছে, এই অস্থায়ী কাঠের সেতু (দুর্গাপুর-শিবগঞ্জ) একটি অলাভজনক প্রকল্প। সেতু নির্মাণে ব্যারিস্টার কায়সার কামালের অর্থায়নে ১৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। পথচারী, বাইসাইকেল, রিকশা, প্যাডেলচালিত ভ্যান, গরু-ছাগল, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের মালামাল পারাপারে কোনো টাকা লাগবে না। শুধু ব্যক্তিগত গাড়ি, মালবাহী গাড়ি, পিকআপ, সিএনজি-ইজিবাইক ও মোটরসাইকেল টোল আদায়যোগ্য। অর্জিত অর্থ স্থানীয় ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুদান এবং মানবকল্যাণে ব্যয় করা হবে লেখা রয়েছে।
স্থানীয় স্মরণিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জামাল উদ্দিন বলেন, গত ১৫ ডিসেম্বর সেতুটি চালু হয়েছে। প্রায় পাঁচ মাসের মতো সেতুটি ব্যবহার করা যাবে। ঘাটে স্থায়ী সেতু দরকার।
সেতু দিয়ে গাড়িসহ পার হচ্ছিলেন নেত্রকোনার শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খন্দকার মোহাম্মদ আশরাফুল মুনিম, ট্রেজারার আনিছা পারভিনসহ প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মকর্তা। উপাচার্য বলেন, ‘দীর্ঘ কাঠের সেতুটি দিয়ে পার হচ্ছি, ভালো লাগছে। সেতু না থাকলে সরাসরি গাড়ি নিয়ে যাওয়া যেত না, দুর্ভোগ পোহাতে হতো।’
সেতু নির্মাণে স্বেচ্ছায় শ্রম দেওয়া গাঁকান্দিয়ার মো. শাহ আলম, দক্ষিণ ভবানীপুরের জাহাঙ্গীর মাহমুদ, রুমান আহমেদসহ কয়েকজন জানান, তাঁরা গত ২০ নভেম্বর থেকে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করেন। প্রচুর বাঁশ-কাঠ পুঁতে এর ওপর কাঠের পাটাতন নির্মাণ করা হয়। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৭৫০ ফুট এবং প্রস্থ ৮ ফুট। সেতুটি নির্মাণ করতে ব্যয় হয়েছে ১৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
সেখানে স্থায়ী সেতু হতে কত দূর, এ বিষয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের নেত্রকোনা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহমুদ আলনূর সালেহীন প্রথম আলোকে বলেন, ওই নদীর ওপর সেতু নির্মাণে ইতিমধ্যে বিদেশি প্রতিষ্ঠান স্মেক-সিসট্রা-এসিই জয়েন্ট ভেঞ্চার জরিপকাজ সম্পন্ন করেছে।