অসুস্থ বাবাকে নিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেল কিশোরী আকলিমা

প্রধানমন্ত্রীর উপহার দেওয়া নতুন ঘরের বারান্দায় কিশোরী আকলিমা খাতুন ও তার বাবা হেলাল উদ্দিন। সোমবার দুপুরে পঞ্চগড় সদর উপজেলার ধাক্কামারা ইউনিয়নে
ছবি: রাজিউর রহমান

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া নতুন ঘরের বারান্দায় বসে ফুল গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত কিশোরী আকলিমা খাতুন (১৪)। ঘরের কোনায় সেলাই মেশিনটি রেখে পরিপাটি করে সাজিয়েছে শোবার ঘর। আকলিমার চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক। শেষ বয়সে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন আকলিমার অসুস্থ বাবা হেলাল উদ্দিন (৬৫)। আজ সোমবার দুপুরে পঞ্চগড় সদর উপজেলার ধাক্কামারা ইউনিয়নের ঢেমশীমারী আশ্রয়ণ প্রকল্পে গিয়ে এমন দৃশ্যই চোখে পড়ে। একসময় বাবার ওষুধ ও খাবারের জন্য আকলিমাকে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামতে হয়েছিল।

চলতি বছরের ২১ জুলাই পঞ্চগড় জেলাকে গৃহ ও ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণার আগেই আকলিমার বাবা হেলাল উদ্দিনের হাতে দুই শতক জমির দলিল তুলে দেয় জেলা প্রশাসন। এরপর ঢেমশীমারী এলাকায় আকলিমাদের জন্য পাকা ঘর প্রস্তুত হওয়ার পর বুঝিয়ে দেওয়া হয় ঘরের চাবি। আজ সকালে সেই ঘরে উঠেছে আকলিমা ও তার বাবা হেলাল উদ্দিন।

২০২০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় ‘বাবার ওষুধ ও ভাতের জন্য মানুষের কাছে হাত পাতে মেয়েটি’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর অনেকে আকলিমার সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। পরে আকলিমাকে আর ভিক্ষা করতে হয়নি। তবে নিজেদের বাড়ি না থাকায় বাবা-মেয়ে থাকত অন্যের ঘরে। এবার মুজিব বর্ষের ঘর পেয়ে আকলিমার সেই দুঃখ ঘুচল।

সম্প্রতি মুজিব বর্ষ উপলক্ষে পঞ্চগড় জেলাকে ভূমি ও গৃহহীনমুক্ত ঘোষণার আগে এ প্রতিবেদকের কাছে আকলিমার সর্বশেষ অবস্থা জানতে চান জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম। প্রথম আলোতে সংবাদ প্রকাশের পর অর্থসহায়তা পেলেও অন্যের ঘরে থাকার কথা জানতে পেরে জেলা প্রশাসক তাৎক্ষণিকভাবে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসুদুল হককে আকলিমাদের জন্য ঘর বরাদ্দের নির্দেশ দেন। এরপর আকলিমার বাবা হেলাল উদ্দিনের নামে দুই শতক জমি রেজিস্ট্রিসহ পাকা ঘর করে দেন ইউএনও মাসুদুল হক।

অসুস্থ হেলাল উদ্দিনকে নিয়ে পঞ্চগড়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম রেলস্টেশন এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকত আকলিমা। হেলালের পৈতৃক বাড়ি মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলায়। ঢাকার সাভারের হেমায়েতপুর এলাকায় নির্মাণশ্রমিকের কাজ করতেন তিনি। তাঁর প্রথম স্ত্রীর পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ে আছে। দ্বিতীয় বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে সাভার এলাকায় আলাদা থাকতেন তিনি। সেখানেই জন্ম হয় আকলিমার। তার বয়স যখন দুই বছর, তখন নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে আকলিমার মা নাসিমা আক্তার মারা যান। এরপর ছোট মেয়েকে নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েন হেলাল।

দীর্ঘদিন আশপাশের লোকজনের কাছে মেয়েকে রেখে কাজে যেতেন। অনেক কষ্টে মেয়েকে বড় করে স্থানীয় একটি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ান। বছর পাঁচেক আগে হৃদ্‌রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হন। এরপর দিনাজপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যান। সেখানে প্রায় দুই বছর অন্যের সাহায্যে কোনোমতে চলছিল বাবা-মেয়ের জীবন। ২০১৯ সালের শুরুর দিকে পঞ্চগড় রেলস্টেশন এলাকায় চলে আসেন তিনি। মাঝেমধ্যে হেলাল মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাহায্য তুললেও অসুস্থতার কারণে পারতেন না। পুরো সংসারের চাপ পড়ে আকলিমার ওপর। প্রতিদিন বাবার জন্য চিকিৎসকের দেওয়া পুরোনো ব্যবস্থাপত্রে লেখা ৬৫ টাকার ওষুধ ও খাবার জোগাড় করতে সকাল হলেই ভিক্ষার থলি নিয়ে বের হতো আকলিমা। দিনভর জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ভিক্ষা করে বিকেলে বাড়ি ফিরে রান্না করে বাবাকে খাবার দিত।

অর্থসহায়তার পর নতুন ঘর পেয়ে আকলিমা বলে, ‘প্রথম আলো পত্রিকার কারণে আমি আর বাবা মানুষের সহযোগিতা পেয়েছি। ঢাকার এক আঙ্কেল আমাদের প্রতি মাসে টাকা দেন। ওই টাকা দিয়ে বাবার ওষুধ কিনি আর বাবা-মেয়ে মিলে খাই। তথ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে যে ভ্যান পেয়েছি, সেটা ভাড়া দিয়েছি। এখন নতুন ঘর পেয়েছি, এখানে নিরাপদে থাকতে পারব। বাবা এখন মোটামুটি ভালো। আমি স্কুলে যাচ্ছি। মানুষের মতো মানুষ হতে চাই।’

হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমার ছোট মেয়েটা সারা দিন শহরে ভিক্ষা করত। এইটা সাংবাদিকের চোখে পড়ছিল। এরপর আর তাকে ভিক্ষা করতে হয়নি। অনেক মানুষের সহযোগিতা পেয়েছি। প্রথম আলো আর আমাদের সাহায্য করা মানুষের জন্য দোয়া করি। এখন জমিসহ পাকা ঘর পেয়ে মনে হচ্ছে, আমি মরে গেলেও মেয়েটা নিরাপদে থাকতে পারবে।’

জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী দেশের ভূমিহীন, গৃহহীন মানুষের জন্য যে বাসস্থানের ব্যবস্থা করছেন, তারই প্রমাণ আকলিমাদের ঘর উপহার। ‘দেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না’, প্রধানমন্ত্রীর এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে আকলিমা ও তার বাবা একটি নিরাপদ আশ্রয় পেলেন। জেলা প্রশাসন সব সময় আকলিমার পাশে থাকবে।