আগে ৯০% মানুষের পানি পাওয়ার কথা বলা হতো। এখন সরকার বদলের পর হিসাবও বদলে গেছে।
চট্টগ্রামের ৯০ শতাংশ মানুষ পানি পাচ্ছে—এমন তথ্য এত দিন জানিয়ে আসছিল ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। তবে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তথ্যও বদলে গেছে। এখন সংস্থাটি বলছে, ৯০ নয়, ৬৫ শতাংশ মানুষ পানি পাচ্ছে।
সম্প্রতি ওয়াসার কর্মকাণ্ড এবং সমাপ্ত, চলমান ও প্রক্রিয়াধীন উন্নয়ন প্রকল্পের সারসংক্ষেপ নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এতে বলা হয়, বর্তমানে চট্টগ্রামে পানির চাহিদা ৫৬ কোটি লিটার। উৎপাদন সক্ষমতা দৈনিক ৫০ কোটি লিটার। গ্রাহক সংযোগ রয়েছে ৯৮ হাজার। হালদা ও কর্ণফুলী নদী থেকে আসে ৯২ শতাংশ পানি ও গভীর নলকূপ থেকে পাওয়া যায় ৮ শতাংশ পানি। ‘কাভারেজ’ ৬৫ শতাংশ।
৯০ শতাংশ মানুষের পানি পাওয়ার তথ্যটি কোনোভাবেই সঠিক ছিল না। মানুষ পানির কষ্টে আছে। এই কষ্ট লাঘবে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। কারিগরি অপচয় কমাতে হবে।মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক, চুয়েট
সংস্থাটির তিন প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করে প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরে যে জনসংখ্যা রয়েছে, তার ৬৫ শতাংশ ওয়াসার পানি পাচ্ছে। এই তথ্যকেই ‘ কাভারেজ’ বলা হচ্ছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে বলা হতো, নগরের ৯০ শতাংশ মানুষ পানি পাচ্ছে। ওয়াসার সদ্য বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম ফজলুল্লাহর নির্দেশনায় বেশি মানুষ পানি পাচ্ছে বলে দেখানো হতো।
২০২০ সালের অক্টোবরে ‘প্রাণজল’ নামে সংস্থার একটি প্রকাশনায় ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। ২০১১ সালে ‘চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন ও স্যানিটেশন’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রাণজলে ওই প্রকল্প সম্পর্কে বলা হয়েছে, এটি বাস্তবায়িত হওয়ায় নগরের পানি সরবরাহ কাভারেজ প্রায় ৯০ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব হয়েছে। নগরের নতুন নতুন এলাকা পানি সরবরাহের ব্যবস্থার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।
আবার সংস্থাটির ওয়েবসাইটে বর্তমান সক্ষমতা তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, গ্রাহকের ৯০ শতাংশ ওয়াসার পানি পাচ্ছে। আর কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-২ চালু হলে চট্টগ্রাম শহরের শতভাগ পানি সরবরাহ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে। অথচ তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত প্রকল্পটি গত বছরের জুনে শেষ হয়েছে। ৯০ শতাংশ মানুষও পানির আওতায় আসেনি।
বিগত সময়ে তথ্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হতো বলে মন্তব্য করেছেন ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী জাতীয় প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শহরের ৯০ শতাংশ ওয়াসার মানুষ পানি পাচ্ছে, এ তথ্য বানোয়াট। বাস্তবতা হলো, হাজার কোটি টাকা খরচ করেও ওয়াসা পানির সংকট দূর করতে পারেনি।
তথ্য নিয়ে প্রশ্ন
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে ২০২২ সালে প্রকাশিত জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট জনসংখ্যা ৩২ লাখ ৩০ হাজার ৫০৭। যদিও সিটি করপোরেশনের হিসাবে, নগরের আনুমানিক জনসংখ্যা ৬০ লাখ। তবে ওয়াসা পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য ধরে প্রকল্পের পরিকল্পনা করে। ফলে ৩২ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ মানুষ পানির সুবিধা পায় না। আবার সিটি করপোরেশনের জনসংখ্যার হিসাব ধরলে ২১ লাখ মানুষের দুয়ারে পানি পৌঁছায় না। নগরের পতেঙ্গা, দক্ষিণ হালিশহর, ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী, উত্তর কাট্টলি, দক্ষিণ কাট্টলি, বাকলিয়া, চান্দগাঁও, সিঅ্যান্ডবি, পাহাড়তলীসহ একাধিক এলাকায় সপ্তাহে এক দিনও পানি যায় না। কোথাও কোথাও এখনো ওয়াসার সংযোগ লাইনও বসেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চট্টগ্রামের জনসংখ্যা নিয়ে সরকারি সংস্থার হিসাবেই মিল নেই। ওয়াসার পানি চট্টগ্রামের ৫০ শতাংশ মানুষ পায় কি না, সন্দেহ রয়েছে। এ নিয়ে বিস্তারিত কোনো জরিপও হয়নি। ওয়াসা ৬৫ শতাংশের হিসাব কোন প্রক্রিয়ায় বের করেছে, তা স্পষ্ট নয়। যথাযথ জরিপের মাধ্যমে সঠিক তথ্য বের না করলে সংকটের সমাধান হবে না।
ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম নগরে পানির সংকট থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনেক এলাকায় এখনো সংযোগই দেওয়া যায়নি। গভীর নলকূপ ব্যবহার করে পানির চাহিদা মেটাচ্ছেন গ্রাহকেরা।
আসল চিত্র কী
ওয়াসার কর্ণফুলী পানি শোধনাগার-১ ও ২ থেকে আসে ১৪ কোটি করে ২৮ কোটি লিটার, মদুনাঘাট পানি শোধনাগার থেকে ৯ কোটি লিটার ও মোহরা পানি শোধনাগার থেকে আসে ৯ কোটি লিটার। এ ছাড়া গভীর নলকূপ থেকে আসে ৪ কোটি লিটার পানি।
সংস্থাটির নথিপত্র অনুযায়ী, প্রতিদিন যে পরিমাণ পানি উৎপাদন করে, তার প্রায় ৩০ শতাংশ ‘সিস্টেম লস’ (কারিগরি অপচয়) হিসেবে দেখানো হয়। অর্থাৎ কাগজে-কলমে প্রতিদিন ওয়াসার গড় উৎপাদন ৫০ কোটি লিটার হলেও গ্রাহকের কাছে পৌঁছায় ৩৫ কোটি লিটার। বাকি ১৫ কোটি লিটার নষ্ট হচ্ছে। এই পানির বিল আসে না। এভাবে বছরে নষ্ট হচ্ছে প্রায় ৫ হাজার ৪৭৫ কোটি লিটার। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ এক বছর ধরে দাবি করে আসছে, বর্তমানে এক হাজার লিটার পানি উৎপাদন করতে খরচ হচ্ছে ৩১ টাকা। সে হিসাবে ৫ হাজার ৪৭৫ কোটি লিটার পানির উৎপাদন খরচ প্রায় ১৭০ কোটি টাকা। পুরো টাকাটাই ওয়াসার ক্ষতি।
পানি সরবরাহের মাধ্যমে ওয়াসার গ্রাহকসেবার মান বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৯০ শতাংশ মানুষ পানি পাওয়ার তথ্যটি কোনোভাবেই সঠিক ছিল না। মানুষ পানির কষ্টে আছে। এই কষ্ট লাঘবে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। কারিগরি অপচয় কমাতে হবে।