পাড়ায় পাড়ায় গরাইয়া নাচে বৈসু উৎসবের আগমনী

পুরোনো বছরের বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে ত্রিপুরা গ্রামগুলোতে সপ্তাহখানেক আগে থেকে শুরু হয়েছে গরাইয়া নাচ। আজ খাগড়াছড়ি টাউন হল প্রাঙ্গণে
ছবি: প্রথম আলো

ত্রিপুরা পাড়াগুলোয় এখন দূর থেকে শোনা যাচ্ছে দোল আর বাঁশির শব্দ। দল বেঁধে একদল লোক জমায়েত হয়ে বাদ্য বাজিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরছেন। যে গৃহস্থের বাড়ির উঠান বড়, সেখানে থামছেন তাঁরা। সুসজ্জিত এই দল গোল হয়ে সেখানে গরাইয়া নাচ পরিবেশন করছেন। নাচ শেষে আবার দোল আর বাঁশি বাজাতে বাজাতে পাহাড়ি পথ ধরে আরেক গৃহস্থের বাড়িতে যাচ্ছেন। তাঁদের পরনে সাদা ধুতি এবং সাদা, নীল, হলুদ রঙের জামা। কোমরে, মাথায় ও হাতে রিসা নামে একটি লম্বা ঝুলের কাপড়।

খাগড়াছড়ি শহরের বৈসু মেলা, দীঘিনালা, গুইমারা, ভাইবোনছড়া ও খাগড়াপুর এলাকায় দেখা যাচ্ছে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের এই দলগুলোকে। নববর্ষ অর্থাৎ ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বৈসু উৎসবের সপ্তাহখানেক আগে থেকে পুরোনো বছরের বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে ত্রিপুরা গ্রামগুলোতে শুরু হয় গরাইয়া নাচ। ত্রিপুরাদের বিশ্বাস, নাচের মধ্য দিয়ে তুষ্ট হন গরাইয়া দেব। এতে পরিবার, এলাকাবাসীর ও সমাজের সুখ-সমৃদ্ধি অটুট থাকে।

ত্রিপুরা গ্রামগুলোতে একসময় তরুণেরা তরুণীদের সামনে গরাইয়া নাচে নিজেদের পারদর্শিতা জাহির করতেন। এর মাধ্যমে তরুণীরা নিজের পছন্দের তরুণকে বেছে নিতেন।

গরাইয়া নাচে অংশগ্রহণকারীদের ‘খেয়েবাই’ বলা হয়ে থাকে। একজন আচাই বা ওঝা ও একজন দেওয়াই (দলনেতা) এই নাচ পরিচালনা করেন। গরাইয়া নাচে রয়েছে ২২টি তাল ও মুদ্রা। এই ২২ মুদ্রায় মানবজীবনের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব ক্রিয়াকলাপ প্রদর্শিত হয়ে থাকে। এই নাচে কেউ একবার অংশ নিলে তাঁকে পরপর তিনবার অংশ নিতে হয়। কেউ যদি কোনো কারণে অংশ নিতে না পারেন, তবে ক্ষমা চাইতে হয় গরাইয়া দেবের কাছে।

বৈসু উপলক্ষে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। আজ খাগড়াছড়ি আদালত সড়কে

দীঘিনালা এলাকার গরাইয়া নাচের দলের সদস্য আচাই আনন্দ মোহন ত্রিপুরা (২৭) বলেন, গরাইয়ার দলের সদস্যরা গৃহস্থের উঠানে ২২টি মুদ্রা প্রদর্শন শেষে শুরু হয় বাড়ির কর্তা ও নারীদের নানা বায়না। নাচের মুদ্রায় কেউ দেখতে চান তরুণ-তরুণীর প্রেম-বিরহ, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া। নাচ শেষে গরাইয়া দল পায় পানীয়, টাকা, চালসহ নানা ফলমূল। গরাইয়া নাচ পরিবেশনের শেষ দিন দলের সদস্যরা গরাইয়া দেবতার উদ্দেশ্যে পূজা দিয়ে মঙ্গল কামনা করেন।

একসময় ত্রিপুরাদের বাড়িতে বাড়িতে গরাইয়া নাচ প্রদর্শিত হতো। তবে বর্তমানে নির্দিষ্ট এলাকায় এবং বৈসাবি উৎসবে এটি অনুষ্ঠিত হয়। ত্রিপুরা গ্রামগুলোতে একসময় তরুণেরা তরুণীদের সামনে গরাইয়া নাচে নিজেদের পারদর্শিতা জাহির করতেন। এর মাধ্যমে তরুণীরা নিজের পছন্দের তরুণকে বেছে নিতেন। তবে বর্তমানে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অংশ নিচ্ছেন গরাইয়া নাচে।