মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র অন্যতম প্রধান চরিত্র কপিলাকে ঘিরে নাটোরে মঞ্চস্থ হয়েছে যাত্রাপালা ‘নবাবের দরবারে কপিলা’। গতকাল মঙ্গলবার রাতে ৫৬ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হয় নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার কাদিরাবাদের গ্যারিসন সিনেমা হলে। সাধারণ মানুষের অসাধারণ অভিনয় দেখতে এখানে ভিড় করেন নানা বয়সী ও শ্রেণি-পেশার দুই শতাধিক দর্শক।
কাদিরাবাদ ক্যান্টনমেন্ট স্যাপার কলেজের প্রভাষক ফারুক হোসেনের রচনা ও নির্দেশনায় ‘নবাবের দরবারে কপিলা’ মঞ্চস্থ করে চলন নাটুয়া শিল্পীগোষ্ঠী। এটি ছিল তাদের সপ্তম প্রযোজনা। যাত্রাপালায় যাঁরা অভিনয় করেছেন তাঁরা কেউই পেশাদার শিল্পী নন। তাঁরা এলাকার খেটে খাওয়া প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ। পেশায় তাঁরা নরসুন্দর, দিনমজুর, রাজমিস্ত্রি, ঘরামি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দিনমজুর, ছাত্র, ভ্যানচালক ও কৃষক। নিয়মিত চর্চা ও বাংলা সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা থেকেই তাঁরা লোকসংস্কৃতির অকৃত্রিম অনুষঙ্গ যাত্রাপালা মঞ্চস্থ করেছেন।
গতকাল রাত নয়টায় শুরু হয়ে রাত ১০টা পর্যন্ত গ্যারিসন সিনেমা হলের মঞ্চে যখন যাত্রাপালাটি চলছিল, তখন সামনের সব কটি আসন ছিল দর্শকে ঠাসা। ভ্যাপসা গরম উপেক্ষা করে যাত্রাপালার নির্মল আনন্দ উপভোগ করেন তাঁরা।
নাটক দেখতে আসা দর্শকদের মধ্যে একজন ছিলেন কাদিরাবাদ ক্যান্টনমেন্টের নির্বাহী কর্মকর্তা সরকার অসীম কুমার। তিনি বলেন, মৃতপ্রায় সংস্কৃতি যাত্রাপালাকে চলন নাটুয়া শিল্পীগোষ্ঠী যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, এ জন্য তাদের সাধুবাদ। সাধারণ মানুষের অসাধারণ অভিনয়দক্ষতা দেখে তিনি মুগ্ধতার কথা জানান। সমাজকর্মী আনছার আলী মণ্ডল বলেন, এমন আয়োজন ঘন ঘন হওয়া উচিত। এতে আকাশ–সংস্কৃতির একচেটিয়া প্রভাব লোপ পাবে।
যাত্রাপালাটির নির্দেশক ফারুক হোসেন বলেন, যাত্রাপালায় কেন্দ্রীয় চরিত্র কপিলা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের বিশেষ আলোচিত চরিত্র। চরিত্রটিকে নেওয়া হয়েছে দুটি কারণে। প্রথমত, কপিলার সঙ্গে কুবেরের সম্পর্ক প্রশ্নবিদ্ধ, যা পাঠককে আলাদা করে ভাবতে বাধ্য করে। মার্ক্সবাদী লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কুবের-কপিলার চরিত্র এমনভাবে তুলে ধরেছেন, দোষারোপ দূরের কথা, বরং তা অনিবার্য হয়ে পড়েছে। কপিলা চরিত্র নির্বাচনের দ্বিতীয় কারণ, নারী। ব্যক্তি হিসেবে কপিলার জীবনে যা ভুল বা অঘটন ঘটেছিল, তা হলো, কপিলার বড় দিদি মালার স্বামী কুবেরের হাত ধরে ময়নাদ্বীপে পালিয়ে যাওয়া।
নির্দেশক ফারুক হোসেন বলেন, যাত্রাপালায় নবাবের কথা, পোশাক ও দরবারের কথা সচেতনভাবে ফুটে উঠেছে। দরবারের বাকি চরিত্রগুলোর মধ্যে সিপাহসালারকে রাখা হয়েছে, যাতে করে একটি তরবারি যুদ্ধ দেখানো যায়। সিপাহসালার রাজ্যের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলেও মসনদের প্রতি লোভ তাঁকে বিপথগামী করে। তাঁকে বন্দী করা হয়। নবাব ও সিপাহসালার সম্মুখযুদ্ধে নবাব জয় পান। এ পালায় দেখা যায় কয়েকজন শিশু চরিত্রকে, যারা স্কুল শেষে খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত। শিশুশ্রমের বিষয়টি অনুভাবনার জন্ম দিতে পারে। পালাকার বিষয়টি দর্শকের বিচার-বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। আবহমানকাল ধরে যাত্রাপালার যে ঐতিহ্য, নবাবি জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক, তা ব্যবহার করে দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে যাত্রাপালাটিতে।