রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির
রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির

রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাঙালিরাও অপহরণের আতঙ্কে, সক্রিয় ১৪ সন্ত্রাসী বাহিনী

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরের শরণার্থীদের পাশাপাশি স্থানীয় বাঙালিরাও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আতঙ্কে ভুগছেন। টেকনাফের গহিন অরণ্যের পাহাড়-জঙ্গলে আস্তানা গড়ে বাংলাদেশিদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করছে সন্ত্রাসীরা। হত্যার পর লাশ গুম করার অভিযোগও আছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, আগে আশ্রয়শিবিরে ইয়াবা ও সোনা চোরাচালানে জড়িত রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পেত ১০-১৪টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। দেড় বছর আগে রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মুখে সন্ত্রাসীরা আশ্রয়শিবির থেকে বিতাড়িত হয়ে পাহাড়-জঙ্গলে অবস্থান নেয়। অর্থের জোগান পেতে তারা স্থানীয় লোকজনের ঘরবাড়িতে লুটপাট ও লোকজনকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ে নেমেছে। তাতে টেকনাফের ৩টি ইউনিয়নের ১৫ গ্রামের অন্তত ৭০ হাজার মানুষ আতঙ্কে রয়েছেন।

সর্বশেষ ৮ জানুয়ারি সকালে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের লেচুয়াপ্রাং এলাকা থেকে চার কৃষককে অপহরণ করে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। তাঁরা হলেন লেচুয়াপ্রাং গ্রামের আবদুস সালাম, আবদুর রহমান এবং দুই ভাই মুহিব উল্লাহ ও আবদুল হাকিম।

সর্বশেষ খবর মতে, অপহৃত এই চার কৃষকের মধ্য তিনজনকে ছয় লাখ টাকার মুক্তিপণের বিনিময়ে ফিরে এসেছেন। গতকাল মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে হ্নীলা পাহাড়ি এলাকা থেকে তাঁরা ছাড়া পান। তবে এখনো আব্দুস সালাম সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি রয়েছে। তারা সালামের পরিবারের কাছ থেকে ১০লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করছে।

আবদুস সালামের ছোট ভাই রফিক আহমদ জানান, রাতের বেলায় বন্য হাতির দল ভুট্টাখেতে নেমে পড়ে। পাহারার জন্য অপহৃত চারজন টংঘরে ঘুমিয়েছিলেন। ভোররাত সাড়ে চারটার দিকে অস্ত্রধারী ১৫-২০ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ওই চারজনকে অপহরণ করে পাহাড়ের ভেতরে নিয়ে যায়। খেতে রক্তের দাগ দেখা গেছে। ধারণ করা হচ্ছে, অপহরণের সময় চারজনের কাউকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে।

হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, গত ১৮ ডিসেম্বর টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের ৮ কৃষককে অপহরণ করেছিল রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। ৪ দিন পর ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছিলেন সবাই।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য বলছে, ৫ বছরে উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরগুলোতে ১২৩ জন খুনের শিকার হয়েছেন। মুক্তিপণের জন্য ৫ বছরে আশ্রয়শিবির থেকেই অপহরণ করা হয়েছে ২০৭ জন রোহিঙ্গাকে।

পুলিশ জানায়, গত ২ আগস্ট টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের একটি পাহাড়ি জঙ্গলে অভিযান চালিয়ে অপহরণের শিকার চার বাংলাদেশি নাগরিককে উদ্ধার করেছে র‍্যাব। ৩০ জুলাই রাতে তাঁদের মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করেছিল রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। উদ্ধার ব্যক্তিরা হলেন উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের নোয়াখালীয়া পাড়ার আমিনুর রহমান (১৪), মোহাম্মদ নুর (১৩), মো. ইলিয়াস (৩৮) ও সৈয়দ আহাম্মদ (৬৫)।

উদ্ধার মোহাম্মদ নুর বলেন, পাহাড়ি আস্তানায় তাঁদের হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছিল এবং সবার হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে ছবি তুলে রাখে। এরপর ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণের জন্য তাঁদের ওপর চালানো হয় ব্যাপক নির্যাতন। সন্ত্রাসীদের ছিল সশস্ত্র।

র‍্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রোহিঙ্গা নেতাদের তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে পাহাড়ের ডেরাতে নিয়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা অন্তত ৪৩ জনকে হত্যা ও লাশ গুম করেছে বলে অভিযোগ আছে। নিহতদের মধ্যে ৩২ জন রোহিঙ্গা ও ১১ জন বাংলাদেশি।

খুন-গুমের যত ঘটনা মিজ্জির পাহাড়ে

টেকনাফের উনচিপ্রাং আশ্রয়শিবিরে পেছনে (পশ্চিমে) জুমপাহাড়। এই পাহাড় পেরিয়ে পশ্চিম দিকে আরও ১০ কিলোমিটার গেলে সামনে পড়ে গহিন অরণ্যের মিজ্জির পাহাড়। যাকে স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন খুনের পাহাড়। এই পাহাড় ঘিরে চলে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের যত খুনখারাবি, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা।

স্থানীয় কৃষক ও কাঠুরিয়ারা বলেন, মিজ্জির পাহাড়ের উত্তর দিকে টইঙ্গার পাহাড়, উখিয়ার পানেরছড়া ও মধুরছড়া পাহাড়। দক্ষিণ দিকে টেকনাফের নেটংপাহাড়, কালা পাহাড় ও শিলখালী পাহাড়। নেটং থেকে উত্তরের মধুরছড়া পর্যন্ত ৪৫ কিলোমিটার লম্বা পাহাড়সারির পূর্ব পাশে গড়ে উঠেছে সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর ৩৩টি আশ্রয়শিবির।

আশ্রয়শিবির থেকে বিতাড়িত ১২-১৪টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনীর ৫ শতাধিক সদস্য এখন মিজ্জির পাহাড়সহ আশপাশের জঙ্গলে পরিখা ও গোপন আস্তানা তৈরি করে মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছে।

কাঠুরিয়ারা বলেন, মিজ্জির পাহাড়ে যেতে পথে পথে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর একাধিক আস্তানা চোখে পড়ে। গাছের ওপর তক্তা দিয়ে বানানো হয় একাধিক টংঘর ও চৌকি। পাহাড়ের বিভিন্ন খাদে একাধিক গুহাও নজরে পড়ে। মিজ্জির পাহাড়ের পাশে পানেরছড়া পাহাড়ে ঝিরিতে প্রায় সময় দেখা মেলে মানুষের কঙ্কাল ও মাথার খুলি কিংবা মরা মানুষের হাত ও পায়ের হাড়। অপহরণের পর মুক্তিপণ না পেলে হত্যা করে লাশ ঝিরিতে ফেলে দেওয়া হয়। দুর্গম এলাকা বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পা পড়ে না সেখানে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন কৃষক বলেন, গত ১০-১৫ দিনে ৪০ জনের বেশি মানুষকে মিজ্জির পাহাড়ে এনে আটকে রেখেছিল সন্ত্রাসীরা। তাঁদের ভাগ্যে কী জুটেছে, জানা নেই।

রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ১৫টি বাহিনীর ৯টি নিয়ন্ত্রণ করেন মিয়ানমার থেকে ইয়াবা ও আইসের (ক্রিস্টাল মেথ) চালান সরবরাহকারী রোহিঙ্গা নবী হোসেন। ২০২২ সালের মার্চ মাসে সন্ত্রাসী নবী হোসেনকে ধরিয়ে দিতে ১০ লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির তৎকালীন অধিনায়ক। অপর ছয়টি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ করে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘আরাকান স্যালভেশন আর্মি’ (আরসা)। মাদক চোরাচালান, আশ্রয়শিবিরে আধিপত্য বিস্তার এবং মাদকের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে গত চার মাসে দুই পক্ষের সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলি-সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত ২৩ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ১১ জন নবী হোসেনের সমর্থক রোহিঙ্গা মাঝি, ৫ জন আরসার সদস্য।

উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবির থেকে সম্প্রতি এই গ্রেনেড উদ্ধার হয়

৮ এপিবিএন গত এক বছরে টেকনাফ ও উখিয়ার পাহাড়-জঙ্গলে অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আমেরিকার তৈরি একটি এম-১৬ রাইফেলসহ ২৩৫টি অস্ত্র, ৫৩৪টি গুলি, ৯১ ভরি সোনাসহ ১ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করেছিল। ড্রোন উড়িয়ে পাহাড়ে খনন করা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পরিখার সন্ধান পেয়ে সেখান থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছিল।

১৪ এপিবিএন অধিনায়ক ও পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক সৈয়দ হারুন অর রশীদ বলেন, মাদক চোরাচালান ঘিরে কয়েকটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৎপর রয়েছে। চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করছে এপিবিএনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

বিচার হয় না

টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, তাঁর ইউনিয়নের কম্বনিয়াপাড়া মহেশখালিয়াপাড়া, কাঞ্জরপাড়া, খারাংখালী, সাতঘড়িয়াপাড়া, রইক্ষ্যম এলাকায় এক হাজারের বেশি পরিবার রোহিঙ্গা ডাকাত ও সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি রয়েছে। এ পর্যন্ত চারজন স্থানীয় বাসিন্দাকে অপহরণের পর মুক্তিপণ না পেয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাঁদের একজন হোয়াইক্যং আলী আছিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের দপ্তরি।

হ্নীলা ইউপির চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, তাঁর এলাকার দমদমিয়া, জাদিমোরা, লেদা, আলীখালী, রঙ্গিখালী, পানখালী, কম্মুনিয়াপাড়া ও মরিচ্চ্যঘোনা এলাকায় দেড় হাজারের বেশি পরিবার রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা গত এক বছরে ৫০ জনের বেশি মানুষকে ধরে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করেছে। চাঁদা না পাওয়ায় যুবলীগের নেতা ওমর ফারুক ও স্থানীয় বাসিন্দা মো. হোসেনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

বাহারছড়া ইউপির চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন বলেন, তাঁর ইউনিয়নে অপহরণের ঘটনা বেড়েছে। সমুদ্র উপকূলীয় এই ইউনিয়নের অন্তত দুই হাজার পরিবার ডাকাতের আতঙ্কে আছে।

পুলিশ, এপিবিএনসহ বিভিন্ন দপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, গত ৫ বছরে উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরগুলোতে ১২৩ জন খুনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৯১ জনকে হত্যার ঘটনায় করা ৮১ মামলায় আসামি করা হয়েছে ৩৮৪ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে। অবশিষ্ট ৩২ জন খুন হয়েছেন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের একাধিক বাহিনীর গোলাগুলিতে এবং অপহরণের পর খুন-গুমের ঘটনায়। মুক্তিপণের জন্য গত ৫ বছরে আশ্রয়শিবির থেকেই অপহরণ করা হয়েছে ২০৭ জন রোহিঙ্গাকে। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯১ জনের বেশি রোহিঙ্গা নারী।

পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৫ বছর তিন মাসে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয়শিবিরে ১৭ প্রকারের অপরাধের বিপরীতে ৫ হাজার ২২৯ জন রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২ হাজার ৪২৫টি। সবচেয়ে বেশি মাদক মামলা ১ হাজার ৫৬৪টিতে আসামি করা হয়েছে ২ হাজার ৩৮৫ জন রোহিঙ্গাকে। একই সময়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছিল ১৭৬টি অস্ত্র।