নির্বাচনমুখী আওয়ামী লীগে মনোনয়ন নিয়ে বর্তমান সংসদ সদস্য ও স্থানীয় নেতাদের দ্বন্দ্ব আছে। সংসদীয় আসন পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় জাতীয় পার্টি।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গাইবান্ধায় প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। কমিটি নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের প্রকাশ্যে কোনো বিরোধ না থাকলেও মনোনয়ন নিয়ে বর্তমান সংসদ সদস্যদের সঙ্গে নেতাদের দ্বন্দ্ব আছে। সহযোগী সংগঠনের কমিটিগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ।
অন্যদিকে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়েই চলছে জেলা বিএনপি। সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে মিছিল-সমাবেশ করছেন নেতা-কর্মীরা। মামলা-হামলা ও গ্রেপ্তার আতঙ্কে কোণঠাসা তাঁরা। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির (জাপা) আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবের মধ্যে মতানৈক্য দূর করার চেষ্টায় গতকাল বৃহস্পতিবার সম্মেলন হলেও কমিটি ঘোষণা করেননি দলের চেয়ারম্যান।
গত বছর সম্মেলনের মাধ্যমে আবু বকর সিদ্দিককে সভাপতি ও মোজাম্মেল হক মণ্ডলকে সাধারণ সম্পাদক করে জেলা আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি হয়। এর প্রায় সাত মাস পর পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হয়। কমিটি নিয়ে বিরোধ না থাকলেও দলীয় মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্যদের সঙ্গে কয়েকজন নেতার বিরোধ আছে।
গাইবান্ধা-২ (সদর) আসনে টানা তিনবারের সংসদ সদস্য জাতীয় সংসদের হুইপ মাহাবুব আরা বেগম। তাঁর সঙ্গে মনোনয়ন নিয়ে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহ সারোয়ার কবীরের মতানৈক্য তৈরি হয়েছে। প্রার্থী হতে সারোয়ার এবার মাঠে নেমেছেন। এ ছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবু বকর সিদ্দিক, সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক মণ্ডল, সহসভাপতি ফরহাদ আবদুল্যাহ হারুন, সহসভাপতি শাহ মাসুদ জাহাঙ্গীর কবির, সাংগঠনিক সম্পাদক আমিনুর জামান দলীয় মনোনয়ন চাইবেন।
শাহ মাসুদ জাহাঙ্গীর কবির বলেন, দলীয় সংসদ সদস্য হয়েও গত পৌর নির্বাচনে মাহাবুব আরা বেগম বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন। এ জন্য নৌকার প্রার্থী হেরে যান। তিনি ত্যাগী নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন না করায় দলের একটি অংশ তাঁর বিপক্ষে।
এ ব্যাপারে সংসদ সদস্য মাহবুব আরা বেগমের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর অনুসারী সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মৃদুল মুস্তাফিজ বলেন, যাঁরা সংসদ সদস্যের কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন, নিজেদের কারণেই গেছেন।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগে দুটি ধারা বিদ্যমান। এক পক্ষে উপজেলা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ প্রধান ও অন্য পক্ষে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ। গাইবান্ধা-৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য মনোয়ার হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে তাঁরা দুজন মনোনয়ন চাইবেন।
আবদুল লতিফ বলেন, আবুল কালাম দলীয় কর্মসূচিতে থাকেন না। নিজেকে জাহির করতে তিনি পৃথক সভা-সমাবেশ করেন। তবে আবুল কালাম আজাদ বলেন, এলাকার জনগণ ও যুবসমাজ সমাবেশের আয়োজন করছে। তিনি শুধু সেখানে নৌকায় ভোট চাইছেন।
সাদুল্যাপুর ও পলাশবাড়ী উপজেলা নিয়ে গঠিত গাইবান্ধা-৩ আসনের সংসদ সদস্য উম্মে কুলসুম কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক। সাদুল্যাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহরিয়ার খান বলেন, সংসদ সদস্য বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকে কৃষক লীগে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। পলাশবাড়ী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম মোকছেদ চৌধুরীর সঙ্গেও সংসদ সদস্যের দ্বন্দ্ব রয়েছে।
উম্মে কুলসুম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগের। দুই উপজেলা চেয়ারম্যানই দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। দল যাঁকে মনোনয়ন দেবে, আমি তাঁর পক্ষে কাজ করব।’
গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনে প্রয়াত সংসদ সদস্য মনজুরুল ইসলামের বড় বোন ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফরুজা বারী এবং স্ত্রী খুরশিদ জাহান মনোনয়নপ্রত্যাশী। মনোনয়ন নিয়ে তাঁদের দ্বন্দ্ব তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়েছে। সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলা নিয়ে গঠিত গাইবান্ধা-৫ আসনে প্রচারণা চালাচ্ছেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সংসদ সদস্য মাহমুদ হাসান। প্রয়াত ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বীর মেয়ে ফারজানা রাব্বী এখানে মনোনয়নপ্রত্যাশী।
২০১৮ সালে সর্বশেষ মইনুল হাসানকে সভাপতি ও মাহমুদুন নবীকে সাধারণ সম্পাদক করে জেলা বিএনপির কমিটি গঠন করা হয়। সাতটি উপজেলা ও চারটি পৌর ইউনিটের মধ্যে ছয় মাস আগে পলাশবাড়ী উপজেলা ও পৌরসভা এবং দুই মাস আগে ফুলছড়ি উপজেলায় সম্মেলনের মাধ্যমে আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। বাকি পাঁচটি উপজেলা এবং তিনটি পৌরসভায় মেয়াদোত্তীর্ণ আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চলছে সাংগঠনিক কার্যক্রম। যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদল, শ্রমিক দল ও কৃষক দলের কমিটিও মেয়াদোত্তীর্ণ।
মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির বিষয়ে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুন নবী বলেন, ঘন ঘন কর্মসূচি থাকায় নেতা-কর্মীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। এ জন্য সম্মেলন করতে দেরি হচ্ছে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, কেন্দ্রের নির্দেশনা না থাকায় এখনই তাঁরা নির্বাচন নিয়ে ভাবছেন না। এখন তাঁরা সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন। পুলিশের বাধা-নির্যাতন উপেক্ষা করে তাঁরা মিছিল সমাবেশ করছেন। গ্রেপ্তার আতঙ্কে তাঁরা কোণঠাসা।
জেলা বিএনপির সহসভাপতি কাজী আমিরুল ইসলাম বলেন, ২০১৪ সাল থেকে জেলায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে তিন শতাধিক মামলা হয়েছে। ২০ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের ভয়ে নেতা-কর্মীরা বাড়িতে ঘুমাতে পারেন না।
দলীয় সূত্র জানায়, নির্বাচন হলে গাইবান্ধা-৩ আসনে জেলার সভাপতি মইনুল হাসান, গাইবান্ধা-২ আসনে কেন্দ্রীয় গ্রাম সরকারবিষয়ক সম্পাদক আনিসুজ্জামান খান ও জেলার সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুন নবী এবং গাইবান্ধা-৫ আসনে জেলার সহসভাপতি ফারুক আলম প্রার্থী হতে পারেন।
২০১৯ সালে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রশিদ সরকারকে আহ্বায়ক ও সরওয়ার হোসেনকে সদস্যসচিব করে জেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। ৩ বছর ৯ মাস পর গতকাল দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের উপস্থিতিতে সম্মেলন হলেও কমিটি ঘোষণা করা হয়নি। সুন্দরগঞ্জ উপজেলা ছাড়া বাকি উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন কমিটিগুলোর একই অবস্থা। এ ছাড়া জেলার আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবের মধ্যে বিরোধ জেলা থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত।
গতকাল রাতে আবদুর রশিদ সরকার বলেন, তাঁকে সভাপতি ও সরওয়ার হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে গেছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
জাপার একটি সূত্র জানায়, আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবের মধ্যে যে মতানৈক্য ছিল, গতকালের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তার সুরাহা হওয়ার পথ তৈরি হলো।
একসময় গাইবান্ধার পাঁচটি আসন জাপার দখলে ছিল। ২০০১ ও ২০০৮ সালে একটি করে আসনে জিতলেও ২০১৪ সালে সব কটি আসনে হেরে যায়। একাদশ সংসদ নির্বাচনে শামীম হায়দার দল থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এবার পাঁচটি আসনই পুনরুদ্ধার করতে চায় জাপা।