চুয়াডাঙ্গায় টানা তিন দিন ধরে প্রচণ্ড দাবদাহ বইছে। বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়ায় জেলাজুড়ে অনুভূত হচ্ছে ‘মরুর উষ্ণতা’। আজ বৃহস্পতিবার বেলা তিনটায় জেলায় সর্বোচ্চ ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এ নিয়ে টানা তিন দিন জেলায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি অতিক্রম করল। আজ বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ১৫ শতাংশ।
এদিকে বাতাসের আর্দ্রতা বেশি থাকায় ভ্যাপসা গরমে জনজীবনে অস্বস্তি নেমে এসেছে। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন কৃষক-শ্রমিকসহ খেটে খাওয়া মানুষ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মকালীন ছুটির আগেই গরমে ছুটির দাবি করেছেন কেউ কেউ। দাবদাহের ব্যাপারে ইতিমধ্যে অধিদপ্তরে জানিয়েছেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। তবে এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি।
পৌর এলাকার হাটকালুগঞ্জে অবস্থিত প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়ায় বেশি গরম অনুভূত হচ্ছে। গত মঙ্গল ও বুধবার জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল যথাক্রমে ৪০ দশমিক ৬ ও ৪০ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত বছরের ১৯ ও ২০ এপ্রিল মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা অতি তীব্র দাবদাহ। কাছাকাছি সময়ে বৃষ্টি না হলে গত বছরের রেকর্ড এবার ভেঙে যেতে পারে।
প্রচণ্ড দাবদাহ ও ভ্যাপসা গরমের কারণে গায়ে ঘাম বসে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বাসিন্দারা। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জ্বর, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়ায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। এ ছাড়া অ্যাজমা, হাঁপানিসহ শ্বাসকষ্টের রোগীদের ভোগান্তি বেড়েছে।
সদর হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের পরামর্শক মো. আবুল হোসেন বলেন, হাসপাতালের অন্তর্বিভাগ ও বহির্বিভাগ ছাড়াও ব্যক্তিগত চেম্বারে গরমজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীদের চাপ বাড়ছে। রোগীদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে যত্নশীল হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে দাবদাহ চলাকালে ভাজা-পোড়া, চা-কফি ও কোমল পানীয় এড়িয়ে বেশি বেশি পানি, খাওয়ার স্যালাইনসহ তরল খাবার খেতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
প্রচণ্ড গরমে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ। চুয়াডাঙ্গা পৌর কলেজপাড়ার বাসিন্দা নাসির উদ্দিন (৫৮) দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে কামারের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনি বলেন, ‘আগুন নিয়েই আমাগের কাজ। ৪০ বচর ধইরে লোহা পিটিয়ে দা, বঁটি, ছুরি, শাবল, কোদাল তৈরি করে আসচি। গত দুই-তিন ধইরে য্যারাম গরম লাগজে, তাতে এক-দুই ঘণ্টার বেশি কাজ কত্তি পাচছিনে। গরমের কোপে আমিই হাঁপিয়ে যাচ্চি।’
চুয়াডাঙ্গা-আলমডাঙ্গা সড়ক ধরে যাওয়ার পথে ঘোড়ামারা এলাকায় কৃষক আব্দুল মান্নানের সঙ্গে কথা হয়। বাড়িতে পোষা গরুর জন্য ঘাস কেটে ভ্যান ঠেলে বাড়িতে ফিরছিলেন। আব্দুল মান্নান বলেন, ‘বাড়িতি বেশ কডা গোরু আচে। ঘাস কাটতি গিয়েলাম। গরমের ঠ্যালায় দুই বুজার মতো কেটে আর টিকতি পাল্লাম না। তাই বাড়িতি চলে যাচ্চি।’
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সদর উপজেলার হাজরাহাটি-বোয়ালমারী মাঠে গিয়ে মাত্র একজন চাষিকে পাওয়া গেল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, প্রচণ্ড দাবদাহে কৃষিশ্রমিকেরা কাজের সময় পরিবর্তন করেছেন। ভোরে আজানের সময় কাজে যোগ দিয়ে রোদের তেজ বাড়ার আগেই বাড়িতে যাচ্ছেন।
হাজরাহাটি মাঠের কৃষক আইনুল হোসেন এবার এক বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদ করেছেন। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ধান চাষে বেশি খরচ হবে বলে জানালেন। কারণ হিসেবে আইনুল হোসেন বলেন, ‘অ্যাকন ধান পাকার সুমায়। ভুঁইতি পানি দিয়ার পরপরই তাপের ঠ্যালায় শুকি যাচ্চে। আবার জমিতি পানি না থাকলি ধান ঝইরে পড়ে যাবে। পিরায় কুড়ি দিন ধইরে ধানের ভুঁইতি বেশি বেশি করে পানি দিতি হচ্ছে। ইতি অনেক খরজ বাইড়ে যাচ্চে।’
সদর উপজেলার সরোজগঞ্জের বাসিন্দা দুধের খামারের মালিক জিয়াউর রহমান বলেন, তাঁর খামারে ১৪টি গাভিসহ মোট ২৮টি গরু আছে। দুই সপ্তাহ ধরে তাপ বেড়ে যাওয়ায় খামারে গরুর হাঁসফাঁস অবস্থা। গরম থেকে বাঁচাতে দিনে-রাতে সমানে বৈদ্যুতিক পাখা ও টিনের চালে পানি ঢালতে হচ্ছে। চিকিৎসকের পরামর্শে গরুগুলোকে নিয়মিত গোসল করানো ও গ্লুকোজ খাওয়ানো হচ্ছে।
এদিকে অভিভাবকদের পক্ষ থেকে চলমান দাবদাহ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার দাবি উঠেছে। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আতাউর রহমান বলেন, চুয়াডাঙ্গার প্রচণ্ড দাবদাহের বিষয়টি অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে জানানো হয়েছে। তবে এ বিষয়ে এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি।