মেহেদির রং মোছার আগেই স্বামীর মৃত্যুতে স্বপ্ন ভেঙে চুরমার ইশরাতের

মাত্র পাঁচ দিন আগে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন ইশরাত–ছানোয়ার
ছবি: সংগৃহীত

অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য ছানোয়ার জাহানের সঙ্গে মাত্র পাঁচ দিন আগে বিয়ে হয়েছিল ইশরাত জাহান ওরফে রিতুর। হাতের মেহেদির রং এখনো শুকায়নি। এরই মধ্যে ট্রেন দুর্ঘটনায় স্বামীকে হারিয়ে শোকের সাগরে ভাসছেন ইশরাত। দুই পরিবারে চলছে মাতম।

ছানোয়ার জাহান (২৮) শেরপুর সদর উপজেলার চরজঙ্গলদী গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে। ২০১৫ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। তবে অসুস্থতার কারণে ২০১৯ সালে অবসর নেন। এরপর গ্রামেই থাকতেন। সদর উপজেলার সাপমারী দ্য নিউ অনুপম একাডেমিতে শিক্ষকতা করতেন।

গত শুক্রবার ছানোয়ার বিয়ে করেন জামালপুরের তুলশীরচর ইউনিয়নের হনুমানেরচর গ্রামের কৃষক এমদাদুল হকের মেয়ে ইশরাত জাহানকে (১৮)। বিয়ের মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় গতকাল সকালে জামালপুর সদর উপজেলার বগালী গ্রামে ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত হন তিনি। তাঁর মৃত্যুর খবরে ছানোয়ার ও ইশরাতের পরিবারসহ চরজঙ্গলদী গ্রামে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

গতকাল বিকেলে চরজঙ্গলদী গ্রামের মোল্লাবাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছানোয়ারের বাড়িতে এলাকাবাসী ও স্বজনদের ভিড়। স্বামীর অকালমৃত্যুর শোকে প্রায় নির্বাক হয়ে গেছেন নববধূ ইশরাত। বসতঘরের একটি খাটে দুই পাশে তাঁর শোকাহত বাবা এমদাদুল হক ও মা চায়না বেগম বসে ছিলেন। ছানোয়ারের বাবা জাহাঙ্গীর আলম, মা নুরুন্নাহারসহ স্বজনদের আহাজারি ও কান্নায় আকাশ ভারী হয়ে উঠেছে বাড়ির পরিবেশ।

ট্রেনে কাটা পড়ে অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য ছানোয়ার জাহানের মৃত্যুতে স্বজনদের আহাজারি। গতকাল বিকেলে শেরপুর সদর উপজেলার চরজঙ্গলদী গ্রামের মোল্লাবাড়িতে

ইশরাত জাহান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন, বুধবার সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে কিছু না বলেই বের হয়েছিলেন ছানোয়ার। ব্যবহৃত মুঠোফোনটি ঘরেই রেখে যান। সকাল ৯টার দিকে এক ব্যক্তি তাঁর শ্বশুর জাহাঙ্গীরকে ছানোয়ারের মৃত্যুর সংবাদটি জানান।
আর কোনো কথা বলতে পারছিলেন না ইশরাত। তাঁর মা চায়না বেগম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মেয়ে অকালে বিধবা হয়েছেন। মেয়ের শ্বশুর জীবিত আছেন। এখন তিনিই (শ্বশুর) তাঁর মেয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।

ছানোয়ারের মা নুরুন্নাহার বারবার উচ্চ স্বরে আহাজারি করছিলেন, ‘আমার পোলারে জীবিত ফিরাইয়া দাও, আল্লাহ।’

বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে নিহত ছানোয়ার জাহানের লাশ চরজঙ্গলদী গ্রামের বাড়িতে এসে পৌঁছায়। এ সময় আত্মীয়স্বজন ও এলাকাবাসী কান্নায় ভেঙে পড়েন। রাত ১০টায় জানাজা শেষে চরজঙ্গলদী মোল্লাবাড়ি গণকবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, পেশায় ঠিকাদার জাহাঙ্গীর আলমের তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে ছানোয়ার ছিলেন বড়। মেজ ছেলে শিপন মোল্লা মালয়েশিয়াপ্রবাসী আর ছোট ছেলে রিপন মোল্লা সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। একমাত্র মেয়ে বৃষ্টি আক্তার স্থানীয় একটি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ালেখা করছেন।

পুত্রশোকে বাবা জাহাঙ্গীর আলম বারবার বুক চাপড়াচ্ছিলেন। স্বজনেরা তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। এ সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘জামালপুরে চাকরির একটি সাক্ষাৎকার দেওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল ছানোয়ার। বাড়িতে ও ঠিকই ফিরল। তবে জীবিত নয়, লাশ হয়ে। বাবা হয়ে এই কষ্ট কীভাবে সহ্য করব?’

জাহাঙ্গীর বলেন, ছানোয়ার সেনাবাহিনী থেকে নিয়মিত অবসর ভাতা পেতেন। ভাতা বইয়ে তাঁকে (জাহাঙ্গীর) নমিনি করা আছে। এখন সংসার চালাতে টাকার প্রয়োজন হবে। তাই ছানোয়ারের অবসর ভাতাটি যেন অব্যাহত রাখা হয়, সে জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানান তিনি।

সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক এবং জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য মো. আবদুল হান্নান মোল্লা চরজঙ্গলদী গ্রামের বাসিন্দা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ছানোয়ার খুব ভালো ও সৎ ছেলে ছিলেন। এলাকায় সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতেন। তাঁর (ছানোয়ার) অকালমৃত্যুতে পরিবারটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।