কমিটি না থাকলেও ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য আছে, চলছে সংঘাত

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
ফাইল ছবি

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি না থাকলেও ছাত্রলীগের একাধিক পক্ষ ক্যাম্পাসে সক্রিয় রয়েছে। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এসব পক্ষ প্রায়ই সংঘাতে জড়াচ্ছে। এর মধ্যে একটি পক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের শের-ই-বাংলা হলের কয়েকটি কক্ষে দেশীয় অস্ত্র মজুত করে, যা গত শনিবার অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করেছে কর্তৃপক্ষ।

চলতি বছরের পাঁচ মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত তিনটি বড় ধরনের সংঘাতের ঘটনা ঘটে। শনিবার অস্ত্র উদ্ধারের পর আবারও সংঘাতের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর পর থেকে সাধারণ শিক্ষার্থী—বিশেষ করে আবাসিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তিন শিক্ষার্থীকে হল থেকে বহিষ্কার করেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শের-ই-বাংলা হলের অন্তত ছয় শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগের পক্ষগুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষের সমর্থক বলে মনে করে। এমন সন্দেহে এই হলে অনেক শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করা হয়েছে। এভাবে গত ১ এপ্রিল শের-ই-বাংলা হলে তিন শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হন। আরেকটি পক্ষের সমর্থক ও খবর সরবরাহকারী মনে করেন, তাঁদের ওপর নির্যাতন চালায় একটি পক্ষ।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একাধিক সূত্র জানায়, গত শনিবার শের-ই-বাংলা হলের ২০০৬, ৩০০৫ ও ৫০০৯ নম্বর কক্ষ থেকে দুই শতাধিক জিআই পাইপ, ১৩টি রড, ২টি বগি দা ও মাদকদ্রব্য (গাঁজা) উদ্ধার করা হয়। কক্ষগুলোয় বরিশালের বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারী হিসেবে পরিচিত বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা তাহমিদ জামান ওরফে নাভিদ, একই বর্ষের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী তানজিব ওরফে মঞ্জুসহ তাঁদের অনুসারীরা থাকছিলেন। অভিযানে কক্ষগুলো সিলগালা করে দেয় কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে রোববার সকালে ছাত্রলীগ নেতা তাহমিদ জামান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কক্ষ থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনাটি ষড়যন্ত্র। আমরা ওই অস্ত্র রাখিনি। প্রতিপক্ষের কতিপয় লোক এসব অস্ত্র রেখে আমাদের ফাঁসাতে চাইছে।’ তাঁরা কারা—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তাঁরা পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর অনুসারী অমিত হাসান ওরফে রক্তিমের লোক।’ অমিত হাসানের কর্মীরা আপনাদের কক্ষে ঢুকলেন কীভাবে—জানতে চাইলে এ প্রশ্ন এড়িয়ে যান তাহমিদ।

তবে হল প্রাধ্যক্ষ আবু জাফর মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূলত আধিপত্য ধরে রাখতে এসব অস্ত্র এনে মজুত করা হয়েছিল। এটা টের পেয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ওই সব কক্ষে তালা দিয়ে আমাদের খবর দেন। এরপর আমরা অভিযান চালিয়ে সেগুলো উদ্ধার করি। এর আগের দিন তাহমিদের সমর্থকেরা তাঁদের বিরোধী এক শিক্ষার্থীকে হলের একটি কক্ষ থেকে বের করে দিয়ে নিজেদের অনুগত এক শিক্ষার্থীকে তোলেন।’ প্রাধ্যক্ষ আরও বলেন, ‘তাহমিদ ও তাঁর অনুসারীরা হলের নতুন ভবনের তিনটি কক্ষ দখল নিয়ে আছেন। আমরা হলে অন্য সব কক্ষ দখলমুক্ত করতে পারলেও ওই কক্ষগুলো দখলমুক্ত করতে পারিনি।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ১২ বছরেও ছাত্রলীগের কোনো কমিটি হয়নি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছর ধরে বর্তমান সিটি মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারীদের একচ্ছত্র আধিপত্য। এই পক্ষের নেতা-কর্মীরা বেশ কয়েকবার নিজেদের মধ্যেও সংঘাতে জড়িয়েছেন। বরিশাল সিটি নির্বাচনে এবার সাদিক আবদুল্লাহ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। ফলে পক্ষটি দলীয় প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহর পক্ষে ভেড়ার চেষ্টা করছে। এ জন্য ক্যাম্পাসে আধিপত্য ধরে রাখতে তাঁরা শের-ই-বাংলা হলে গত শুক্রবার রাতে দেশীয় অস্ত্র এনে রেখেছিল।

এর আগে ২০২১ সালের মাঝামাঝি বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের অনুসারী হিসেবে আরেকটি পক্ষ ক্যাম্পাসে সক্রিয় হয়। এই পক্ষের নেতৃত্বে আছেন রক্তিম হাসান ও ময়িদুর রহমান। অন্যদিকে সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারী পক্ষটির নেতৃত্ব দেন মহিউদ্দীন আহমেদ ওরফে সিফাত, আলীম সালেহীসহ কয়েকজন। গত বছরের ৫ জুলাই রাতে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটে। এতে উভয় পক্ষের সাতজন আহত হন। এর পর থেকে প্রতিমন্ত্রীর পক্ষটিকে আর ক্যাম্পাসে দেখা যায়নি।

ছাত্রলীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাঁচ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের বিবদমান পক্ষের মধ্যে সংঘাত ও হামলার ঘটনায় বন্দর থানায় অন্তত ১০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে লঘু অপরাধের একটি মামলায় পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। এ ছাড়া দুটি মামলা মীমাংসা হয়ে গেছে। অন্য মামলাগুলোর এখনো অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এসব মামলায় সাক্ষ্য দিতে গড়িমসিসহ নানা কারণে তদন্ত বিঘ্নিত হয়। এরপরও কিছু মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। বাকি মামলাগুলোর তদন্ত চলছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, প্রতিমন্ত্রীর পক্ষটি ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত থাকায় সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারী মহিউদ্দীন আহমেদ ক্যাম্পাসে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করছিলেন। গত ২৫ জানুয়ারি শের-ই-বাংলা হলের একটি কক্ষে ঢুকে মহিউদ্দীনকে কুপিয়ে জখম করা হয়। এ ঘটনায় তিনি সাতজনকে আসামি বন্দর থানায় মামলা করেন। মামলায় আলীম সালেহী, রিয়াজ মোল্লা ও তাঁদের সহযোগী চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর পর থেকে মহিউদ্দীনের অনুসারী তাহমিদ জামান ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ নেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মো. খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংঘাতের ঘটনায় ঘুরেফিরে ১০ থেকে ১২ জনের নাম আসছে। শুরুতে আমরা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এসব ঘটনায় লঘু শাস্তির দিকটা বিবেচনা করতাম। তবে গুটি কয়েকের জন্য তো আর ১০ হাজার শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা ও শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হতে পারে না। সে জন্য এখন আমরা সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থানে।’

চলমান মামলাগুলোর অগ্রগতি সম্পর্কে খোরশেদ আলম বলেন, ‘অনেক ঘটনায় দেখা যায়, অভিযোগকারী শিক্ষার্থী নিজে নিজে মীমাংসা করে তদন্ত কমিটির কাছে সাক্ষ্য দিতে আসেন না। সে ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার থাকে না। আর ফৌজদারি অপরাধের মামলাগুলো আমরা আইনের হাতে ছেড়ে দিই।’

এদিকে এসব সংঘাতের জন্য কমিটি না থাকাকে দুষছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের অন্তত চারজন নেতা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, কমিটি না থাকায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকা নেতাদের সমর্থন নিয়ে একেকটি পক্ষ গড়ে ওঠে। একই নেতার সমর্থকদের মধ্যেও উপদলে বিভক্ত হয়ে সংঘাতে জড়ানোর ঘটনা ঘটছে।