ধসে পড়া সেতুর গার্ডার সরিয়ে চাপা পড়া মানুষজনকে উদ্ধারের চেষ্টা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর নগরের বহদ্দারহাটে
ধসে পড়া সেতুর গার্ডার সরিয়ে চাপা পড়া মানুষজনকে উদ্ধারের চেষ্টা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর নগরের বহদ্দারহাটে

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ৮ কর্মকর্তার ৭ বছর করে কারাদণ্ড

সাড়ে ১১ বছর আগে চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাটে উড়ালসড়কের গার্ডার ধসে ১৩ ব্যক্তি নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার রায় ঘোষণা করেছেন আদালত। আজ বুধবার দুপুরে চতুর্থ অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভূঞা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আট কর্মকর্তাকে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

সরকারি কৌঁসুলি অনুপম চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, আদালত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার অ্যান্ড পারিশা ট্রেড সিস্টেমসের তৎকালীন ব্যবস্থাপক গিয়াস উদ্দিন, একই প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী মনজুরুল ইসলাম, আবদুল জলিল, আমিনুর রহমান, আবদুল হাই, মোশাররফ হোসেন, শাহজাহান আলী ও রফিকুল ইসলামকে পৃথক দুই ধারায় সাত বছর করে কারাদণ্ড, তিন লাখ টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেন।

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর নগরের বহদ্দারহাটে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নির্মাণাধীন উড়ালসড়কের ১২ ও ১৩ নম্বর গার্ডার ধসে পড়ে। এতে ১৩ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ জনগণ বহদ্দারহাট এলাকার পুলিশ বক্সে আগুন দেয়। এ ঘটনার দুই দিন পর চান্দগাঁও থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক আবুল কালাম বাদী হয়ে ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এতে সিডিএ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা এজাহারভুক্ত আসামি ছিলেন। এরপর শুধু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আটজনকে আসামি করে ওই বছরের ২৪ অক্টোবর অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। আলোচিত এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলির কাছ থেকে মতামত না নিয়ে তা জমা দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের ২৬ মে ফ্লাইওভার ট্র্যাজেডি নিয়ে ‘শনাক্ত হয়নি মূল হোতারা’ শিরোনামে প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর রাষ্ট্রপক্ষ ওই বছরের ৩ জুন অধিকতর তদন্তের আবেদন করেন।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের তৎকালীন সরকারি কৌঁসুলি ফখরুদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগপত্রটি আদালতে জমা দেওয়ার আগে নিয়ম অনুযায়ী পিপির মতামত নেননি তদন্ত কর্মকর্তা। এমনকি অভিযোগপত্রে কোনো ত্রুটি আছে কি না, আদালতে উপস্থাপনের আগে খতিয়ে দেখেনি পুলিশের প্রসিকিউশন শাখাও। এর ফলে অনাপত্তি দেওয়ার সুযোগ ছিল না। তিনি জানান, মহানগর হাকিম আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করে বিচারের জন্য পাঠান মহানগর দায়রা জজ আদালতে। দায়রা জজ আদালতে অভিযোগপত্র পাঠানো হলে মূল হোতাদের বাদ দেওয়ার বিষয়টি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের নজরে আসে। পরে অধিকতর তদন্তের আবেদন করা হলেও খারিজ করে দেন আদালত।

গার্ডার ধসের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ লোকজন বহদ্দারহাট পুলিশ বক্সে আগুন দেয়। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর নগরের বহদ্দারহাটে

অভিযোগপত্র থেকে যাদের বাদ দেওয়া হয়েছে

এজাহারে থাকা আসামি প্রকল্প পরিচালক এ এ এম হাবিবুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক, এম এ মতিন, তানজিব হোসেন, সালাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, হোসাইন আহমেদ, শাহ জাহান, আবদুল হান্নান, আবছার হোসেন, মোস্তাফিজুর রহমান, বাবুল কুমার বিশ্বাস, অরুণ কুমার বিশ্বাস, আবদুল খালেক মিয়া, বায়েজীদ মীর কামাল, মেজবাহুল কবির, সাইদুর রহমান, সোহেল হাছান, তৌহিদুর রহমান ও তারেক মাহমুদকে অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেয় পুলিশ। ২০১৪ সালের ১৮ জুন আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে এই মামলার বিচার শুরু হয়। ২২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য শেষে আদালত এই রায় দেন।

২০১০ সালে এম এ মান্নান (বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার) উড়ালসড়কের নির্মাণকাজ শুরু করেছিল চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। নির্মাণ শেষে ২০১৭ সালে সেটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করা হয়। আজ রায় ঘোষণার সময় আট আসামি উপস্থিত ছিলেন। আদালতের বেঞ্চ সহকারী ওমর ফুয়াদ প্রথম আলোকে বলেন, আদালত জামিনে থাকা আট আসামির জামিন বাতিল করে তাঁদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

উড়াল সড়কে গাডার ধসে ১৩ জন নিহতের মামলার রায় ঘোষণার পর আসামিদের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আজ দুপুরে আদালত ভবনের তৃতীয় তলার বারান্দা থেকে তোলা

আসামি রফিকুল ইসলামের আইনজীবী এসে ইউ এম নুরুল ইসলাম রায় ঘোষণার পর প্রথম আলোকে বলেন, রায়ের এই আদেশের বিরুদ্ধে তাঁরা উচ্চ আদালতে আপিল করবেন।

ঘটনার দিন নিহত ১৩ জনের একজন মোহাম্মদ ইলিয়াস। তার ছেলে মোহাম্মদ ওমর ফারুক রায় ঘোষণার পর আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবাকে আর ফিরে পাব না। কিন্তু আর কাউকে যাতে বাবা হারা হতে না হয়। নির্মাণকাজে সর্বোচ্চ সতর্কতা নেওয়া উচিত। দায়িত্ব অবহেলাকারী আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’