সিলেটের কানাইঘাটে নিখোঁজ মুনতাহা আক্তারের (৫) লাশ সিলেট এম এ জি ওসমানী কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রোববার দুপুরে
সিলেটের কানাইঘাটে নিখোঁজ মুনতাহা আক্তারের (৫) লাশ সিলেট এম এ জি ওসমানী কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রোববার দুপুরে

হাস্যোজ্জ্বল ছোট্ট মুনতাহা এখন কেবলই ছবি

ঠোঁটে লাল রঙের লিপস্টিক। মুখে একরাশ হাসি। ঘাড় পর্যন্ত চিকচিকে কালো চুল। মায়াবী চোখজোড়া অপলক তাকিয়ে আছে। পরনে বেগুনি রঙের জামা। ফুটফুটে সুন্দর শিশু মুনতাহা আক্তারের এই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। পাঁচ বছরের ছোট্ট মুনতাহা এখন কেবলই ছবি।

মুনতাহার বাড়ি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামে। এক ওয়াজ মাহফিল থেকে ৩ নভেম্বর সকালে বাবার সঙ্গে বাড়ি ফিরে সে বাইরে খেলতে যায়। পরে আর খোঁজ মেলেনি। এরপর শিশুটির সন্ধান চেয়ে ফেসবুকে অনেকে পোস্ট দেন। আজ রোববার ভোরে মুনতাহার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, শিশুটিকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

লাশ উদ্ধারের ঘটনা জানাজানির পর মুনতাহার পরিবার তো বটেই, ফেসবুকজুড়েও মাতম চলছে। শিশুটির ছবি দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ ফেসবুকে শেয়ার দিয়ে খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চেয়েছেন। অনেকে শিশুটির হাস্যোজ্জ্বল ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘এমন নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করার মতো পাষণ্ডও আছে?’

শিশু মুনতাহার নিখোঁজ ও লাশ উদ্ধারের বিষয়টি সিলেটসহ সারা দেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। মূলত মুনতাহা নিখোঁজের বিষয়টি কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনায় আসছিল। নিখোঁজ হওয়ার পর মুনতাহার সন্ধান চেয়ে ফেসবুকে অনেকে স্ট্যাটাস দেন। এর মধ্যে সিলেটের সমাজকর্মী ফারমিছ আক্তার মুনতাহার সন্ধানকারীকে সোনার চেইন উপহার দেওয়ার ঘোষণা দেন। মুনতাহার লাশ উদ্ধারের পর তিনি একাধিক আবেগঘন স্ট্যাটাস দেন। একটিতে লেখেন, ‘এত সুন্দর মুখটা কেমন হয়ে গেল রে!’

প্রবাসে থাকা সিলেটের সংস্কৃতিকর্মী আবু বকর আল আমিন লিখেছেন, ‘মানুষ পরিচয়টা এমন মুহূর্তে বড় লজ্জার হয়ে যায়। ক্ষমা করিস রে মা মুনতাহা।’ ওই স্ট্যাটাসে জয় সরকার নামের একজন মন্তব্য করেছেন, ‘আহা, কী মর্মান্তিক! মানুষ পরিচয় দিতে আজ ঘৃণা হচ্ছে।’

সংগীতশিল্পী তসিবা বেগম লিখেছেন, ‘কী অপরাধ ছিল ফেরেশতা বাচ্চাটার? আমরা কি সত্যি মানুষ হতে পারলাম না?’ সংবাদকর্মী লবীব আহমদ লিখেছেন, ‘দিনের ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় যে মহিলার সঙ্গে থাকত মুনতাহা, সেই মহিলাই তার ছোট্ট নিষ্পাপ জীবনকে কেড়ে নিল।’ মুহাম্মদ আশরাফুল নামের একজন মুনতাহা লিখে হ্যাশট্যাগ দিয়ে লিখেছেন, ‘আমাকে খুঁজতেছে সারা বাংলাদেশ। অথচ আমি বাড়ির পাশেই ছিলাম।’

শিশু মুনতাহা আক্তার

সিদ্দিকুর রহমান নামের একজন লিখেছেন, ‘এই নিষ্পাপ ফুলটিকে পিষিয়ে ফেলতে একটুও কষ্ট অনুভব হয়নি? হৃদয়ে মায়ার বেগ জাগ্রত হয়নি? মুনতাহা মৃত্যুর সময় কি চিৎকার দিতে পেরেছিল? মা-আব্বু বলতে পেরেছিল? মুনতাহা মৃত্যুর আগে জেনে গেল, দুনিয়ার মানুষ নিষ্ঠুর, পাষণ্ড হৃদয়ের।’

পুলিশ জানিয়েছে, মুনতাহা উপজেলার সদর ইউনিয়নের বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামের শামীম আহমদের মেয়ে। নিখোঁজের ঘটনায় কানাইঘাট থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছিল। শিশুটির খোঁজ জানালে পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল পরিবার।

নিখোঁজের সাত দিন পর বাড়ির পাশ থেকে শিশুটির লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। শিশুটির লাশ ডোবায় কাদার মধ্যে পুঁতে রাখা ছিল। সন্দেহভাজন হিসেবে মর্জিয়া আক্তার (২৫) নামের এক তরুণী আটক হওয়ার পর তাঁর মা ঘটনাকে অন্য রূপ দিতে লাশ ডোবা থেকে শিশুটির বাড়ির পাশে একটি পুকুরে ফেলে আসতে যান। তখন পথে স্থানীয় লোকজনের হাতে আটক হন ওই নারী।

পুলিশ বলছে, মুনতাহাকে প্রাইভেট পড়াতেন মর্জিয়া। সম্প্রতি মুনতাহার পরিবার মর্জিয়াকে প্রাইভেট পড়ানো থেকে বাদ দেয়। এর জেরেই শিশুটি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। লাশ উদ্ধারের সময় শিশু মুনতাহার শরীরে কাদা লেগে ছিল। গলায় রশিজাতীয় কিছু প্যাঁচানো ছিল। এতে সন্দেহ করা হচ্ছে, গলায় রশিজাতীয় কিছু দিয়ে পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে তাকে হত্যা করা হয়েছে।

আজ দুপুরে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে মুনতাহার লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাদ আসর গ্রামের মসজিদে জানাজা শেষে তার দাফন সম্পন্ন হয়। জানাজায় হাজারো মানুষ অংশ নিয়ে চোখের পানিতে মুনতাহাকে শেষবিদায় জানান।

যোগাযোগ করলে সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. রফিকুল ইসলাম ও কানাইঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুল আওয়াল প্রথম আলোকে বলেন, শিশুটিকে হত্যার পর লাশ গুম করা হয়েছিল। পুলিশ দ্রুততার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করেছে।