দিনের বেলায় বাজারে লোকজনের সমাগম তেমন চোখে পড়ে না, অধিকাংশ দোকানও থাকে বন্ধ। বিকেল পাঁচটার পর থেকে বাজারে লোকসমাগম বাড়তে থাকে। তবে সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত মানুষে গিজগিজ করে বাজার, কোথাও পা রাখার জায়গাও যেন থাকে না। বাজারে মাছ-মাংস, সবজি বিক্রির ধুম পড়ে যায়। বাজারের চায়ের দোকান এবং রেস্তোরাঁয় জমে ওঠে আড্ডা।
কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলার ২ নম্বর দক্ষিণ ধুরুং ইউনিয়নে অবস্থিত এই বাজারের নাম ধুরুং বাজার। বাজারের ক্রেতাদের ৯০ শতাংশই লবণশ্রমিক, বাকিরাও লবণচাষি ও জেলে। বাজারের দোকানপাটে জমে ওঠা আড্ডার সাধারণ বিষয় থাকে লবণ উৎপাদন, লবণ ও মাছের দামদর এবং ব্যবসার লাভ–ক্ষতি। প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো এই বাজারে দোকান আছে এক হাজারের বেশি। বাজারের পাশে রয়েছে মুছামিয়া সিকদার জামে মসজিদ, যা নির্মাণ করা হয় ১৭৩৪ সালে। বাজারটির চারপাশে কয়েক হাজার একরের লবণমাঠ। আছে দক্ষিণ ধুরুং, পূর্বধুরুং, তাবলেরচর ও ডিঙ্গাভাঙ্গা নামের চারটি গ্রাম। সকাল সাতটার দিকে গ্রামের মানুষ লবণমাঠে নেমে পড়েন। সমুদ্রের লোনাপানি মাঠে জমিয়ে সূর্যতাপে তা শুকিয়ে উৎপাদিত করা হয় লবণ। বিকেলে সেই লবণ তোলা শেষ হয়। এরপর চাষিরা ঘরে ফেরেন। কেউ সরাসরি মাঠ থেকে ধুরুং বাজারে এসে কেনাকাটা করেন।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দিনের বেলায় বাজারটি অনেকটা ফাঁকা পড়ে থাকতে দেখা যায়। বাসিন্দারা জানান, বাজারের মূল ক্রেতা লবণচাষি ও শ্রমিকেরা দিনে মাঠে ব্যস্ত থাকেন। তাই দিনে তেমন ক্রেতা থাকে না। সন্ধ্যার পর ক্রেতা বাড়ে।
১০ দশমিক ১১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দক্ষিণ ধুরং ইউনিয়নে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের বসতি। এর মধ্যে অন্তত ১০ হাজার লবণশ্রমিক, অবশিষ্ট ৫ হাজার লবণচাষি ও জেলে। কুতুবদিয়া উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে শাকসবজির আবাদ তেমন নেই। বাজারের শাকসবজি-তরকারি আনা হয় জেলার চকরিয়া, ঈদগড় ও রামুর ঈদগড় থেকে। চাল-ডাল, ভোজ্যতেল, গ্যাস সিলিন্ডার, হলুদ, পেঁয়াজ-আদাসহ নিত্যপণ্য আনা হয় চট্টগ্রাম থেকে ট্রলারে করে। এ কারণে বাজারে সবকিছুরই দাম কিছুটা বাড়তি।
১২ নভেম্বর রাত সাড়ে আটটায় বাজারে ঢুকে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। বাজার থেকে ৯০ টাকায় এক কেজি আলু, ২৩০ টাকায় একটি মুরগি কেনেন তাবলেরচর গ্রামের লবণ শ্রমিক দিলদার হোসেন। তারপর পাশের আরেক দোকান থেকে ৪ কেজি চাল কিনে বাড়ির পথে রওনা দিচ্ছিলেন তিনি। দিলদার (৪৭) প্রথম আলোকে বলেন, সারা দিন লবণমাঠে কাজ করে মজুরি পেয়েছেন ৮০০ টাকা। ৬০০ টাকার কেনাকাটা শেষে বাড়ি ফিরছেন।
সাগরের পাশে বাজারটির অবস্থান হওয়া সত্ত্বেও বাজারে ইলিশ, রুপচাঁদা, সুরমার মতো মাছ দেখা যায়নি। বাজারে লইট্যা বিক্রি হতে দেখা যায় কেজি ২০০ টাকা, তেলাপিয়া ১৯০ টাকা ও পাঙাশ ২১০ টাকা দরে। বাজারে বিক্রি হওয়া এসব লইট্যা কুতুবদিয়া চ্যানেলে ধরা পড়া এবং রুই-পাঙাশ-তেলাপিয়া আনা হয়েছে কক্সবাজার শহর ও চকরিয়া থেকে। পূর্ব ধুরুং বাজারের লবণচাষি আবদুল খালেক ৪০০ টাকায় কেনেন দুই কেজি লইট্যা মাছ। খালেক (৫০) বলেন, সাগরদ্বীপ হলেও বাজারে সামুদ্রিক মাছের নাগাল পাওয়া যায় না। উপজেলাতে দুই হাজারের মতো মাছ ধরার ট্রলার আছে। এসব ট্রলারে ইলিশসহ লাখ লাখ টাকার সামুদ্রিক মাছ ধরা পড়লে বেশির ভাগ চট্টগ্রামে নিয়ে বিক্রি হয়।
উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ধুরুং বাজার। এর উত্তর দিকে উত্তর ধুরুং ইউনিয়ন, পূর্বে লেমশীখালী ইউনিয়ন, দক্ষিণে কৈয়ারবিল ইউনিয়ন এবং পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর। ধুরুং নামে এলাকায় খরস্রোতা একটি নদী ছিল। নদীটির নামেই এলাকা ও বাজারের নামকরণ। বাজারের একটি রেস্টুরেন্টে বসে কথা হয় ধুরুং বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মিছবাহুল আলমের (৪০) সঙ্গে। তিনি বলেন, বাজারের ক্রেতাদের ৯০ শতাংশ লবণশ্রমিক। বাকিরাও জেলে-লবণচাষি। দিনের বেলায় সবাই লবণ উৎপাদন ও সাগরে মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত থাকেন। সন্ধ্যার পর তাঁরা বাজারে আসেন। বাজারের এক হাজার দোকানপাটের মালিকেরা মিলেমিশে ব্যবসা করেন।
ধুরুং বাজারের ইজারাদার কামরুল হাসান সিকদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাতের বেলায় বাজার জমজমাট থাকলেও ক্রেতারা দুর্ভোগের শিকার হন। বাজারে গণশৌচাগার নেই। একটি যাত্রীছাউনি থাকলেও তা পরিত্যক্ত। বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও স্থানীয় দক্ষিণ ধুরুং ইউপির চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আল আজাদ বলেন, বাজারের শান্তিশৃঙ্খলা এবং ব্যবসায়ীদের ঐক্য ধরে রাখতে তাঁরা সব সময় তৎপর থাকেন। প্রতিদিন সকাল-বিকেল বাজার পরিষ্কার করা হয়।
ধুরুং বাজারে ৩০ বছর ধরে একটি ল্যাব পরিচালনা করছেন এম এ মান্নান। তিনি বলেন, জেলা শহরের হাটবাজারগুলো সন্ধ্যার পর যেখানে ফাঁকা হয়ে যায়, সেখানে দুর্গম সাগরদ্বীপের একটি বাজার রাতেই জমজমাট থাকছে কয়েক যুগ ধরে। রাতের আড্ডায় যোগ দিতে আশপাশের ইউনিয়নের লোকজনও বাজারে ছুটে আসেন। এলাকায় লবণ চাষ যত দিন থাকবে, ধুরুং বাজারে রাতের আড্ডা, জমজমাট বিক্রিও তত দিন থাকবে।