চারপাশের গাছপালা উপড়ে মুখ খুবড়ে পড়ে আছে। ভিটাসহ তিনটি পরিবারের ছয়টি ঘর দেবে মাটির নিচে চলে গেছে। কিছুদিন আগে যেখানে ঘরগুলো ছিল, স্থানটি এখন ডোবায় পরিণত হয়েছে। বন্যার পানি সরে গেলেও ধ্বংসাবশেষ এখনো স্পষ্ট। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মোগড়া ইউনিয়নের খলাপাড়া এলাকার চিত্র এটি।
ঘরগুলো বিধ্বস্ত হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা স্বজনদের বাড়ি কিংবা অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। ওই স্থান মাটি দিয়ে ভরাট করে নতুন ঘর নির্মাণ না করা পর্যন্ত তারা ফিরতে পারবে না। নতুন বাড়ি নির্মাণ করার জন্য টাকা কোথায় পাবেন, তা ভেবে তাঁরা এখন শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন।
পাহাড়ি ঢলের পানিতে সৃষ্ট বন্যায় এই এলাকার আবদুর রউফ ভূঁইয়ার দুটি টিনের ঘর; তাঁর ভাই সেলিম ভূঁইয়ার টিনের তিনটি ঘর ও একটি শৌচাগার এবং আবুল বাশারের একটি টিনের ঘর সম্পূর্ণভাবে দেবে গেছে।
পাহাড়ি ঢলের পানিতে সৃষ্ট বন্যায় এই এলাকার আবদুর রউফ ভূঁইয়ার দুটি টিনের ঘর; তাঁর ভাই সেলিম ভূঁইয়ার টিনের তিনটি ঘর ও একটি শৌচাগার এবং আবুল বাশারের একটি টিনের ঘর সম্পূর্ণভাবে দেবে গেছে। একই জায়গায় থাকা আবুল হোসেনের বড় ছেলে ইসমাইল ও আবুল বাদশার টিনের ঘরের মেঝে দেবে গেছে। প্রতিটি বসতঘরের ভিটা পাকা, চারপাশে দেয়াল ও ওপরে টিনের চাল ছিল। বন্যায় ঘরগুলো দেবে যাওয়ায় পাঁচটি পরিবারের মধ্যে কেউ প্রতিবেশী আবার কেউ স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক আবদুর রউফ স্ত্রী নারগিছ বেগমকে নিয়ে প্রতিবেশীর বসতঘরের সিঁড়িতে বসে পাশের ডোবায় যেখানে তাঁদের দুটি বসতঘর ছিল, সেদিকে তাকিয়ে আছেন। দুটি ঘরের একটিতে আবদুর রউফ ভূঁইয়া ও স্ত্রী নারগিছ এবং অপর ঘরে মেয়ে নাসরিন ও তাঁর স্বামী ইসমাইল মিয়া বসবাস করতেন। ১২ দিন ধরে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তিনি চাচাতো ভাই শাহজাহান ভূঁইয়ার বাড়িতে বসবাস করছেন।
কথা হলে আবদুর রউফ ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত ২১ আগস্ট রাতে প্রসাব করতে ঘুম থেকে উঠি। কিছুক্ষণের মধ্যে মেঝের মাটি দেবে বসতঘরে গলাপানি হয়ে যায়। কোনোরকমে বাড়ির উত্তর দিক দিয়ে বের হয়ে প্রাণ বাঁচাই। মাটি চার থেকে পাঁচ ফুট দেবে গেছে।’ তিনি জানান, মেঝেসহ বসতঘরের কিছুই নেই, আছে শুধু ধ্বংসাবশেষ।
খলাপাড়ার আরেক বাসিন্দা আবুল হোসেন বলেন, ‘একটি টিনের ঘরে সৌদিপ্রবাসী ছেলে মো. ইসমাইলের স্ত্রী আশা আক্তার ও নাতি আবদুল্লাহ থাকত। কিন্তু ওই দিন (২১ আগস্ট) বসতঘরের মেঝের মাটি দেবে যাওয়ায় তারা এখন আমার সঙ্গে আছে।’
সেলিম ভূঁইয়া বলেন, ‘আমার তিনটি টিনের ঘর দেবে গেছে। ঘরের মালামাল ভেঙে ভেসে গেছে। শৌচাগার হেলে পড়েছে। একটি সুতাও বের করতে পারিনি। মধ্যরাতে স্ত্রী আয়েশা বেগমকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে প্রাণে বাঁচি। এর পর থেকে চাচাতো ভাই শাহ আলম ভূঁইয়ার বাড়িতে আছি। কৃষিকাজ করে সংসার চালাই। মাটি দিয়ে জায়গাটি ভরাট না করলে নতুন করে ঘর নির্মাণ করা সম্ভব নয়। দেবে যাওয়া স্থান মাটি দিয়ে ভরাট করতে অনেক টাকা লাগবে।’
আবুল বাদশা বলেন, ‘ওই দিন রাতে দুই ছেলে আনোয়ার হোসেন, ফজলে রাব্বিসহ তিনজন ঘরে ছিলাম। বন্যার পানিতে রাতেই বসতঘর দেবে গেছে।’
খলাপাড়ার আরেক বাসিন্দা দুলাল মিয়া বলেন, ‘স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বউসহ চারজন ঘরে ছিলাম। রাত দুইটার দিকে বাঁধের পাড় বাঁধছিলাম।কিন্তু বাঁধ ধরে রাখতে পারছিলাম না। ঘরে পানি ঢুকতে শুরু করলে কিছু মাল বের করার পরপরই ভিটাসহ ঘর দেবে যায়।’
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২১ আগস্ট দিবাগত রাত থেকে ভারী বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে আখাউড়ার হাওড়া নদীতে পানি ঢুকতে শুরু করে। বন্যার পানি হাওড়া নদীর খলাপাড়া বাঁধের ওপর দিয়ে যেতে শুরু করে। রাত আড়াইটার দিকে খলাপাড়া এলাকার কবরস্থান ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের নদীর বাঁধের তিনটি অংশ ভেঙে বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়। এ ছাড়া পানির চাপে উপজেলার দুটি সড়কের আটটি স্থান ভেঙে যায়। রাত আড়াইটা থেকে তিনটার দিকে খলপাড়ার পূর্ব-উত্তর দিকের জায়গায় থাকা তিনজনের বসতঘরসহ চার থেকে পাঁচ ফুট দেবে যায়। বাসিন্দারা কোনোমতে বসতঘর থেকে বের হয়ে প্রাণ বাঁচান। আসবাবসহ ঘরের মালামাল বিলীন হয়ে যাওয়ায় তাঁরা এখন ভীষণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন।
সাম্প্রতিক বন্যায় খলাপাড়া এলাকাসহ আখাউড়া উপজেলার বেশ কিছু এলাকার হাজারো মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর মধ্যে যাঁদের ঘর নেই, তাঁরা অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন, কেউ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় নিজের জায়গায় কোনোরকমে দিন যাপন করছেন।
ভোরে পানি চারটি ঘরের চারপাশের টিন ও ঘরের সব আসবাব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কোনোরকমে ভাঙাচোরা ঘরে স্বামী-সন্তানদের নিয়ে বসবাস করছি।শারমিন আক্তার, গৃহবধূ, আইড়ল গ্রাম, আখাউড়া
মোগড়া ইউনিয়নের আইড়ল গ্রামে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বসবাস করেন মো. আসাদুল্লাহ ও তাঁর বড় ভাই বাবু সরকার। হাওড়া নদীর সংলগ্ন কর্নেল বাজার-ইটনা সড়কের আইড়ল অংশ ২২ আগস্ট ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে পাহাড়ি ঢলের পানিতে ভেঙে যায়।
আসাদুল্লাহর স্ত্রী শারমিন আক্তার বলেন, ‘ভোরে পানি চারটি ঘরের চারপাশের টিন ও ঘরের সব আসবাব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কোনোরকমে ভাঙাচোরা ঘরে স্বামী-সন্তানদের নিয়ে বসবাস করছি।’
আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গাজালা পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, বন্যায় উপজেলার ১ হাজার ৬৯৭টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইটনা, আইড়ল ও খলাপাড়ায় ৯টি বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেককে তিন বান্ডিল ঢেউটিন দেওয়া হবে। বেসরকারি উদ্যোগে এখন পর্যন্ত খলাপাড়ার ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।